ইসলামী বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা

ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মাঝে সংঘাতের ধারা শুরু ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় উত্থানের ধারা শুরু হয়, সাথে শুরু হয় ইসলামী বিশ্বে উপনিবেশবাদের ধারা। তার বিপরীতে মুসলমানদের মাঝে বিরাজ করে স্থবিরতা, প্রচলন ছিল অন্ধানুসরণের, শাসকশ্রেণী মেতে উঠে ভোগ্যতায়, চিন্তকশ্রেণী হারিয়ে ফেলে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি; এছাড়াও মুসলমানদের প্রাতিস্বিক অবনতি, সামাজিক সম্পর্কের অনুন্নয়ন পারিপার্শ্বিক কারণ হিসেবে কাজ করে উপনিবেশবাদের।

এহেন পরিস্থিতিতে তদানীন্তন মুসলমানরা তাদের খেলাফতের মসনদে বসে আগাম বিপ্লবের পূর্বাভাস দেখছিল। পশ্চিমা উন্নয়নের প্রভাব পড়ে খেলাফতে উসমানিয়্যাহ প্রাণকেন্দ্রে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের মিসর আক্রমণের মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বেও তার প্রতিক্রিয়া ছড়ায়। তার প্রভাব-প্রতিপত্তির খুটি স্থাপিত হয় জামিয়াতুল আজহারেও। যখন এমনিতেই মুসলমানদের ইসলামী চিন্তাবৃত্তির টলটলে ভাব, তখনই তার পরিবর্তে সামাজিকীকরণে প্রভাব পড়ে ফরাসি চিন্তাবৃত্তির।

এ চিন্তাবৃত্তি ইসলামী সমাজব্যবস্থায় তার যুগপৎ অবস্থান তৈরি করতে পারেনি যে, তাকে সামাজিকভাবে সুউচ্চ মনে করা হবে এবং নব্য ইতিহাস রচনার  মৌলিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। যার মাধ্যমে সকল অব্যর্থতা থেকে আমরা সকলে নিষ্কৃতি পাবো। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং আমাদের সামাজিক ক্রমোন্নতিকে ক্রমে ক্রমে পিছিয়ে নিয়েছে[1]।

এ দুর্যোগময় মুহুর্তে এ নব্য সংস্কৃতির সাথে ইসলামী চিন্তাবৃত্তির সংঘাত হয়। ইউরোপ কর্তৃত্ববাদী শক্তির মাধ্যমে মৌলিকত্বের মূল্যবোধের উপর কার্যকরী মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়। তখন থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দু’ধরণের লোকের আনাগোনা। একদলের দৃষ্টি নিজস্ব সংস্কৃতির উপর, তাকে কিভাবে কর্মময় করা যায়। অন্যদলের দৃষ্টি প্রচলিত সংস্কৃতি ও তাদের কর্মতৎপর শক্তির উপর। যেসব মুসলিম ইউরোপীয় চিন্তায় গড়ে ওঠে, তারা শুধু এ কর্মতৎপর দিকটা দেখে। চাঁদের মতো, যখন সে তার একপৃষ্ঠ দেখায় আর অন্য পৃষ্ঠ আড়াল করে রাখে অন্যের থেকে। এর থেকেই তার চিন্তাবৃত্তিক গঠনসত্ত্বায় একই চিন্তার দুই বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয় : স্বাতন্ত্র্য ও কর্মতৎপরতা। এ সংমিশ্রণজাত মানসিকতার কারণে সমকালীন মুসলিম চিন্তায় এমন মনস্তত্ব তৈরি হয়, যা মনোবৃত্তিতে সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করে[2]।  

পশ্চিমা গবেষকরা ইসলামী সভ্যতা ও মানবেতিহাস পাঠের মাধ্যমে চিন্তাবৃত্তিক এ পরিস্থিতি তৈরির ব্যাপারে পূর্ব সচেতন হয়। যার কারণে নেপোলিয়ন বেনপোর্টের মিসর ও সিরিয়া আক্রমণের সময় এ গোপন অভিসন্ধি তাদের নতুন উপনিবেশিক সমাজে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা অনেকাংশে ছিল। এছাড়া তখন তো মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ বিনষ্টের পথে গড়িয়েছিল। নেপোলিয়ন এ আগমন শুধু সামরিক আগ্রাসনের ছাপই বহন করেনি, পশ্চিমা চিন্তাকে স্থিতিশীল করে, যা উত্তর-উপনিবেশিক যুগেও বহাল থাকে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যদি আমরা তৎকালীন পরিস্থিতি দেখি, তবে প্রাচ্য ও আরববিশ্বে পশ্চিমা চিন্তার প্রতিনিধিত্ব। এটা সম্ভব হয় জাতিভিত্তিক আন্তঃসম্পর্কে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ধারা ব্যবহার করে। আমরা এটাও দেখি তার প্রভাবে উপনিবেশিক জাতিগোষ্ঠীর মনে চিন্তাবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কী পরিবর্তন এসেছিল, চাই সেটা বাহ্যিক হোক বা অভ্যন্তরীণ।

১৭৯৮-১৮০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম ফরাসি আক্রমণ মুসলমান ও পাশ্চাত্যের মাঝে সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রথম পদক্ষেপ। তদ্রূপ সেটা জ্ঞানবৃত্তিক ও চিন্তাবৃত্তিক আগ্রাসনের প্রথম ধাপ। যা মুসলমানদের আগে থেকে চলমান সাংস্কৃতিক কোন্দলকে আরো গুরুতর করে। মুসলমানদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করে সামাজিক জীবনে এমনভাবে অনুপ্রবেশ করে যা ইউরোপীয় সামরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ সুগম করে।

এরপর থেকে ইসলামী আইন-কানুন বাস্তবায়িত হয়, এমনসব অঞ্চলে তাদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কনসুলেট আদালত তৈরি হয় বিচারব্যবস্থার জন্য। পরবর্তীতে ইংরেজদের উপনিবেশকালে পারিবারিক বিচারব্যবস্থায় তার প্রভাব পড়ে। মিসরীয় গবেষক মুহাম্মদ উমারা তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় বলেন : “বিশেষভাবে লর্ড ক্রোমারের সময়ে ( ১৮৮৩ সাল) থেকে ইসলামী আইনব্যবস্থার উপর আক্রমণাত্মক অবস্থান তৈরি হয়। বিচারবিভাগীয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে থেকে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করার থেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। এই সাংস্কৃতিক বিকৃতির প্রারম্ভ হয় ফরাসি আক্রমণের পর থেকে”। তিনি ফরাসি আক্রমণ সম্পর্কে বলেন : মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি, ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষরূপে উপস্থাপন, ভাষিক পর্যায়ে ফরাসির প্রভাবকে কার্যকর করা, ইসলামী আইনকানুনের পরিবর্তে ফরাসি নিয়মনীতির প্রচলন-প্রসারণ। এভাবে মুসলিম সমাজব্যবস্থায় ফরাসি প্রভাবের কারণে একধরণের সংমিশ্রণ তৈরি। ফ্রান্সীয় উপনিবেশিক শক্তি পশ্চিম আরবে এ-সব করতে সক্ষম হয়[3]।  

ফরাসি উপনিবেশের কারণে মিসরে যে ছাপাখানার প্রচলন হয়, সেটা তাদের কর্তৃত্বকে যুগপৎ বাস্তবায়ন করার জন্য। নেপোলিয়ন তার প্রথম প্রকাশনায় নিজেকে মিসরবাসী জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে অবিহিত করে। তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তিদান, বিনষ্টের হাত থেকে উত্তোলন, পশ্চাদগামীতা থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। গবেষক মোহাম্মদ সায়্যিদ মোহাম্মদ তার এমনসব বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা তুলে ধরেন পর্যালোচনার মাধ্যমে [4]:

  1. মামলুক শাসনকে স্বৈরাচারী, লিপ্সু ও ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মিসরীয় শাসনব্যবস্থার জন্য ঝুকিপূর্ণভাবে উল্লেখ করা।
  2. মানুষকে ফরাসি শাসনব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান করা, এই হিসেবে যে, তারা মিসরীয়দের মামলুকদের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করবে, দেশকে তাদের বিশৃঙ্খলা নির্মূল করবে।  সাথে সাথে এ শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে শুরু করে যে, তারা এসব করতে বাস্তবেই সক্ষম।
  3. তাই জনগণের মাঝে বলতে থাকে যে, মামলুকদের বিতাড়িত করার ক্ষেত্রে তারা ঐশ্বরিক শক্তির ধারকবাহক।
  4. যুদ্ধ ফরাসি ও মামলুকদের মাঝে, তাই মিসরীয়দের উচিত তারা যেন সংষর্ঘের পথে না আসে।
  5. তাই ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গকে তাদের কর্মের সাথে জুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, যাতে সকলের মাঝে তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।

এ হচ্ছে তাদের চিন্তাবৃত্তিক কর্মক্ষেত্র, মিসরের মতো তারা আলজেরিয়ায়ও বাস্তবায়ন করে। এ ক্ষেত্রে তাদের সফলতার দিক অস্বীকার্য নয়। পরবর্তী কোন আলোচনায় আমরা এ নিয়ে আলোচনা করবো। এভাবেই পশ্চিমাকরণের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে বিষবাষ্প ছড়ায়। বাস্তবতার বিকৃতি, জাতিবিভক্তিকরণ, সামরিক ও চিন্তাবৃত্তিক আগ্রাসন, মুসলমানদের মনস্তত্ত্ব দখল করে দেশীয়ভাবে সমর্থন তৈরি করে।

ইসলামী বিশ্বে এভাবেই আগ্রাসনবাদের প্রচলন হয়। সামরিক ও চিন্তাবৃত্তিক কর্তৃত্ব, উভয়ে একে অপরের সম্পূরক হয়।

এভাবে একসময় উপনিবেশবাদ চলে গেলও উত্তর-উপনিবেশক যুগে তাদের প্রভাব থেকে যুগ যুগ ধরে। ১৯১৭ সালে এসে রাশিয়া এসে নেপোলিয়নের ভাষণ ছড়ায়। তারা সম্ভোধন করে : হে প্রাচ্যীয় মুসলিম! আরব, তুর্কী, ইরানী… যারা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের করতলগত, যারা তোমাদের স্বাধীনতা, ধনসম্পদ ও ব্যক্তিগত অধিকারে কর্তৃত্ব করছে… রাশিয়া প্রশাসন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেশে সশস্ত্র আক্রমণ করবেনা… কিন্তু তারাও চলে চিরাচরিত পথে। স্বয়ং রাশিয়ার ভিতরে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তাদের ভোগান্তির শিকার হয়। এভাবোট বিশ্বের পরাশক্তি তাদের কর্তৃত্ব ও স্বৈরাচার স্থাপনের জন্য নতুন নতুন স্লোগানের উদ্ভাবন করে আর আগ্রাসন চালায় মুসলমানদের উপর।

__________________________________________

مالك بن نبي : الصراع الفكري في البلاد المستعمرة، دمشق، دار الفكر، ،2014 ص : 82  [1]

مالك بن نبي : مشكلة الأفكار، ترجمة: بسام بركة -أحمد شعبو، دمشق، دار القلم . ص. 107   [2]

حمد عمارة : الاحتفال بالاحتلال أم بالاستقلال .  مجلة المسلم المعاصر   [3]

محمد سيّد محمد : الغزو الفكري ّ والمجتمع العربي . ص : 187  [4]

Leave a Reply