পশ্চিমাকরণ

বর্তমান যুগে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ও প্রভাব সঞ্চারের দিক বুঝানোর ক্ষেত্রে “সাংস্কৃতিক আগ্রাসন” “বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ” ইত্যাদি পরিভাষার পাশাপাশি “ওয়েষ্টারনাইজেশন” তথা পশ্চিমাকরণ  পরিভাষাও অন্যতম।

পশ্চিমাকরণ উনিশ ও বিশ শতকে মুসলিম চিন্তায় আগ্রাসনবাদী শক্তির প্রভাব সঞ্চারী  কর্মনীতির মধ্যে অন্যতম। যা চিন্তাবৃত্তিকভাবে ইসলামকে তাদের ভাবনায় সন্দেহজনকভাবে করে। মনে অভ্যন্তরীণভাবে পরিবর্তন তৈরি করে, যার মাধ্যমে সে ভিন্ন চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে, সবকিছুকে সেই মানদণ্ডে দেখে। প্রখ্যাত গবেষক ত্বারেক আল-বাশারী বলেন : এ ক্ষেত্রে মানুষের মূল্যবোধ বিনষ্টের অন্যতম কারণ হচ্ছে, পশ্চিমাকরণ অভ্যন্তরীণ কার্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে বাহ্যিক ফলশ্রুতি বহন করে। যার ফলে তাকেই বাহ্যিক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিসরে ফরাসি আক্রমণকে কতিপয় গবেষক ও চিন্তকশ্রেণী প্রগতি ও বিপ্লবের কারণ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের এই মূল্যায়ন জাতীয় স্বার্থ ও সভ্যতার বিচারে যুগীয় একত্বকে পূর্ণ বিবেচনায় রেখে, কিন্তু এ সম্পৃক্ততা শুধু বস্তুবৃত্তিক বা রাজনৈতিক না, বরং সরাসরি অনুভূতির সাথে সম্পর্ক রাখে[1]। ত্বারেক আল-বাশারী পশ্চিমাকরণের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, যোগসূত্র, মুসলমানদের সঠিক উপলব্ধির বিচ্যুতি, মৌলিকত্ব থেকে দূরবর্তী অবস্থান, ইসলামী সভ্যতার ভাঙন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে বলেন : আমার ধারণামতে বর্তমান আধুনিকতার কারণে আমাদের মাঝে যে মূল্যবোধের সয়লাভ, জাতীয় অর্থে এটা তারই ফলশ্রুতি, পশ্চিমাকরণের মাধ্যমে আমাদের মাঝে যাকে অধিক প্রচলিত করা হয়… তার কুপ্রভাব আমাদের স্বতন্ত্র মনোভাব বিনষ্টের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ না, বরং এর সাথে জুড়ে আছে সাংস্কৃতিক ও বস্তুবৃত্তিক স্বার্থ। তা আমাদের দৃষ্টিকে অতীতে ফেরায়, কিন্তু আমাদের অতীতের অবস্থানকে অটুট রাখেনা।  তদ্রুপ তা আমাদের মাঝে অধীনতাবোধ জাগ্রত করে, মনে ভাঙন তৈরি করে; শুধু বাহ্যিক-বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে না,  বরং আামাদের অনুভূতির গভীরে তার প্রভাবকে সুদৃঢ় করে [2]।

পশ্চিমাকরণের কার্যক্রম মুসলিম বোদ্ধামহলকে নিজস্ব সংস্কৃতির দিকে টেনে নেয় কয়েক মাধ্যমে : তুলনামূলক সাংস্কৃতিক আলোচনা, ( এর মাধ্যমে তাদের পাশ্চাত্যমুখী করা) সংমিশ্রণজাত করা ( এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভস্ত্য করা) এবং মন-মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত করা ( এর মাধ্যমে নিজস্ব ধর্মীয় মানসিকতার প্রতি বিরূপ বোধ তৈরি করে মন-মস্তিষ্ক থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা)।

মুসলিম চিন্তকদের মতে পশ্চিমাকরণ মানে হলো : পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে নতুন বুদ্ধিবৃত্তির বিনির্মান, অতঃপর ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তি ও সমাজনীতির সাথে তাকে দ্বান্দিকভাবে উপস্থাপন করা, পরিশেষে যাতে পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তির কর্তৃত্ব থাকে।

গবেষক ফাহমি জাদআ’নের মতে : পশ্চিমাকরণের সমর্থক মুসলিম চিন্তকদের ইসলামী পরিমণ্ডলের মনে করা যাবেনা। তার এর থেকে সম্পূর্ণ বহির্ভূত। কেননা তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার নৈতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধকে কার্যকরী মনে করে এবং সমগ্র মুসলমানদের এই মতাদর্শ গ্রহণে, অন্যভাবে বললে পাশ্চাত্যের অধীনতা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। গবেষক জালাল আলে আহমদের মতে, পশ্চিমাকরণ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মূল্যবোধ, যা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের সাথে যুক্ত হয়, অথচ তার ঐতিহ্যিক কোন ভিত্তি নেই, ঐতিহাসিক গভীরতা নেই[2]।

উপরোক্ত আলোচনার বিবেচনায় পশ্চিমাকরণ হচ্ছে, ইসলামী বিশ্বে আঠারো শতক থেকে উদ্ভূত এমনসব কর্মকাণ্ড, যা বস্তুবাদ নির্ভর জ্ঞানবৃত্তি ও চিন্তা-দর্শনকে মানববিদ্যা, প্রকৃতিবিদ্যা, স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কিত ধারণা — মোটকথা সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের অনুভূতি থেকে একত্ববাদী ধ্যানধারণাকে বিদূরিত করে পাশ্চাত্যের বস্তুবৃত্তিক ধ্যানধারণার সংস্থাপন।

________________________

[1] طارق البشري: «الإصلاح والتجدد في أمتي صناعة محليّة وحضاريّة «في: الإصلاح في الأمة بين الداخل والخارج، حولية أمتي
في العالم، القاهرة، مركز الحضارة للدراسات السياسيّة، ،2006ص   8.

[2] المرجع نفسه.

[3] فهمي جدعان : أسس التقد ّم عند مفكّري الإسلام في العالم العربي الحديث،بيروت المؤسسة العربيّة للدراسات والنشر،1979 ص . 324

One Reply to “পশ্চিমাকরণ”

Leave a Reply