ইয়াসিনদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই

লেখক: রফিকুল ইসলাম


[ছোটগল্প]

মানুষের এই পৃথিবীতে কতরকম মানুষ যে বাস করে,তা আল্লাহ পাক ছাড়া কারো জানার সাধ্য নেই৷ কত বিচিত্র আমাদের এই দুনিয়া এবং দুনিয়ার মানুষ৷ সবচে’ গুরুতর বৈচিত্র হচ্ছে বৈষয়িক বৈষম্য৷ কেউ উদরপূ্র্তি করে পেটে উঁকুন মারে, কেউ একপেট খেতেও পায় না৷ কেউ ঘুমায় পাঁচতলায়, কেউবা গাছতলায়৷ কেউ শতপ্যাচে সাক্ষর দেয়, কেউ জীবন পার করে টিপসই দিয়ে৷ কেউ শিক্ষার সনদ গলায় ঝুলিয়ে জীবন পার করে, কেউ নিরক্ষর হয়েও দিব্যি খেয়েপরে দিনাতিপাত করে৷ এসবই স্রষ্টার তাকদীর-রহস্য৷ এই রহস্যের জট খোলা আদৌ কারো পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিনি দুনিয়াটাকে এভাবেই সাজিয়েছেন৷
হাড্ডিসার ছেলেটি৷ বয়স ছয় কি সাত৷ চেহারা, পোষাক, জুতোজোড়া জানান দেয় দারিদ্রপীড়িত নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্ম তার৷ কায়দা হাতে এশার নামাজের ক্ষাণিক পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করে কায়দাখানি সযত্নে তাকে রেখে বেরিয়ে যেতেই আমার দৃষ্টি পড়ল তার দিকে৷ ডাক দিলাম৷ গায়ে স্কুক ড্রেস, মানে পরিষ্কার৷ অভাবের সংসার বলে জামা কেনা হচ্ছে না৷ পরনেও ময়লা ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট৷ আধোয়া৷ এরও মানে পরিষ্কার৷ গায়ের রং নিমকালো৷ অযত্ন ত্বক৷ সব মিলিয়ে কৌতূহলী মন তার সাথে কথা বলতে ব্যাগ্র হয়ে উঠেছে৷
এই প্রথম একটা মানুষের সাথে সংলাপ করে আমার চোখ জলপূ্র্ণ হলো৷ মুহুর্তেই অজানা এক মর্মবেদনায় মুষড়ে পড়লাম৷ কত কষ্টময় এদের জীবন,কত সন্তাপময় এদের যাপিত সময়! শেষতক একফোঁটা অশ্রু গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ল৷
‘তোমার নাম কি?’
‘ইয়াসিন৷’
‘কোথায় থাকো?’
হাতে ইশারা করে পাশের গলিতে থাকে বুঝিয়ে দিল৷ বুঝতে বাকি রয়নি, চরম অর্থকষ্টেই আছে তাদের পরিবার৷ কারণ এই গলিতে আমার প্রতিদিনের যাতায়াত৷
‘বাবা বেঁচে আছেন?’
বয়স তার কম হলেও বড়দের মতো কলজেপোড়া নিঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলো–
‘না, বেঁচে নেই৷ কবে মারা গেছেন জানি না৷ মরণব্যাধি আলসার রোগে তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেছেন৷’
‘আম্মু আছেন?’
‘হ্যাঁ৷’
তোমাদের সংসার চলে কিভাবে? জানতে চাইলে জবাব দেয়–সেকথা শুনে কি করবেন? কতজনই তো জিগ্যেস করে, আমাদের খবর নেয়ার তো এই জগতে কারো নেই৷ আম্মা ইট ভাঙ্গে, বড় ভাই রাস্তানির্মাণের কাজ করে৷ গত দুই মাস কাজ করেছে৷ কন্ট্রাক্টর বলেছিল, একত্রে টাকা দিবে৷ দুই মাস গত হবার পর,ভাইয়ার সেকি আনন্দ! একসাথে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা পাবে৷ সংসারের অভাব কিছুটা হলেও ঘুচবে৷ কিন্তু সমস্ত আশার নিরাশায় পরিণত হলো৷ একবিকেলে একবুক আশা নিয়ে ভাইয়া কন্ট্রাক্টারের বাাড়িতে গেল টাকা আনতে৷ কন্ট্রাক্টরার না চিনার ভান করছে, অপরিচিতের মতো কথা বলছে৷ ভাইয়া টাকা চাইলে জবাব দেয়,কিসের টাকা? ভাইয়ার নাকি তখন বেঁহুশ হওয়া অবস্থা৷শেষতক কন্ট্রাক্টার ভাইয়ার কাজ অস্বীকার করে রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দিল ভাইয়াকে৷ পরে জানা গেল, এই টাকা কন্ট্রাক্টারসহ আরো কয়েকজন মিলে খেয়েছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজনের কাছে অভিযোগ করে কোন কাজ হয়নি৷ এরপর থেকে ভাইয়া কেমন যেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন৷ জগৎটা তার কাছে সংকীর্ণ হয়ে আসছে৷ এই জগতে এই পরিমাণ অবিচার হলে বাঁচবে কিভাবে? আগে আম্মু ও ভাইয়া উভয়ের রোজগার দিয়ে কোনরমকে সংসার চলত। এখন দিনে একবারও খেতে পাইনা৷’
ভাই বোন কয়জন জিগ্যেস করলে বলে, ‘আগে আটজন ছিলাম৷ চার ভাই চার বোন৷ পরে বাবার মৃত্যুতে নিতান্ত অভাবে রোগভোগে চারজন মারা গেছেন৷ এখন দুই ভাই দুই বোন আছি৷ বোনদের বয়স যথাক্রমে দুই চার৷’
ছেলেটির কতাবার্তা বেশ সাজানো, জবাবও ঋজু এবং অকপট৷ এই বয়সে এতো সুন্দর করে কিভাবে কথা শিখেছে জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, তার বড় ভাই নাকি তাকে শিখিয়েছে৷ শুনে আশ্চর্যান্বিত হলাম৷ যেখানে নগরের অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ছাওয়ালেরা পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করে,সেখানে বস্তির আজন্ম অশিক্ষিত পরিবারের সন্তানের মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে বাকরুদ্ধ হলাম৷ ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতেই মন চাচ্ছে৷ একে তো দরিদ্রবর্ণনার কথকতা, দ্বিতীয়ত তার কথা বলার ভঙ্গি এবং ত্বরিৎ জবাবের পারঙ্গমতা৷ স্কুলে মাত্র ওয়ানে পড়ে৷ সেখানেও নাকি তাকে সইতে হয় সমবয়স্ক সহপাঠি কর্তৃক নির্যাতন৷ স্যার কিংবা বাবা মা সবাইকে জানানোর পরও নাকি কেউ কান দিচ্ছে না৷ কথাগুলো সে বলছে খুবই দুঃখ এবং ক্ষোভ নিয়ে৷
জিগ্যেস করলাম, ‘দুপুরে খেয়েছে কি-না, রান্নাবান্না হয়েছ কি-না? জবাব দিল, সকালে খাইনি, দুপুর বারোটায় কয়েক নলা খেয়ে একটার দিকে স্কুলে গিয়েছি৷ মাগরিব নাগাদ স্কুল থেকে ফিরেছি৷ এরপর আর খাওয়া হয়নি৷’
দুপুরে কয়েক নলা কেন খেয়েছে জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, ‘তরকারি ঝাল ছিল৷ খেতে পরিনি৷ সবাই ঝাল খায়,আমি পারিনা৷ আম্মু মারধরও করে,কেন খেতে পারি না৷’
প্রতিদিন সকালে এবং রাতে খাওয়া হয় কি-না জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, ‘সকালে একদিনও খাই না৷ রাতে কোন দিন খাই,কোন দিন ঘুমিয়ে পড়ি৷ এভাবেই চলছে দিনরাতের অষ্টপ্রহর৷’

বুঝলাম এখনো পেট খালি৷ কিছু টাকা দিতে পারলে খুশী হবে মনে হয়৷ পকেটে হাত দিতেই সে বুঝে গেছে৷ বলছে, কি করছেন, রাখেন৷ টাকা পয়সা দিয়েন না৷ এমনিতে অনেক ভালো আছি৷ আমার পকেটেও খুব টাকা আছে এমন না৷ খুঁজে দেখি পঞ্চাশ টাকা৷ এটাই তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, কিছু খেয়ে আসো৷ নিতে চায়নি৷ জোরাজুরি করেই দিলাম৷
বড় হয়ে কি হবার ইচ্ছা জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, ‘হাবেস’ হবো৷
‘সেটা কি?’
‘কুরআন শরীফ মুখস্থ করে তারাবী পড়ায় যে, ওটা’৷
‘ও, সেটাকে তো হিফজ বলা হয়৷ এবং ব্যক্তিকে হাফেজ বলা হয়৷’
‘সেটা হতে চাচ্ছো কেন তুমি’?
হাফেজদের অনেক সম্মান, কাল কিয়ামতের দিনেও হাফেজদের পিতামাতকে আল্লাহ পাক নূরের টুপি পরাবেন, হুজুর আমাদেরকে বলেছেন৷’
সবচে’ ভালো লাগে তোমার কি করতে? জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, ‘পড়তে৷ পড়ালেখা করতে আমি ভালো পাই,ভালোলাগে৷ সবিশেষ আরবী পড়তে বেশি ভালো লাগে৷’
এসব জবাব কেউ শিখিয়ে দিয়েছে কি-না জিগ্যেস করলে জবাব দেয়, না, আমার কাছে যা ভালো লাগে তাই বলি৷ কারো শেখানো কথা আমি বলি না, ভালো লাগে না৷’
এতটুকুন ছেলে কিভাবে এতো সুন্দর করে মনকাড়া ভঙ্গিতে সাজিয়ে কথা বলতে পারে, সেই রহস্যের জট আমার খুলেনি৷ বস্তির ছেলের কথাবার্তা এমন মার্জিত,শীলিত –ভাবতেও অবাক লাগে৷

শহরের অলিগলিতে, ঘিঞ্জি-বস্তির ফাকঁ-ফোকরে এনং আঁজপাড়া গাঁয়ে এমন হাজারো প্রতিভাধর শিশু জন্ম নেয় এবং প্রতিভার পারদ নিয়েই মাটির নিচে চলে যায়৷ অন্নসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না তাদের৷ অবস্থাসম্পন্ন লোকরাও খুঁজে নেয় না এদের৷ রাস্ট্র তো নয়-ই৷ অথচ সামান্য চেষ্টা করলেই এদের মিডিয়াতে এনে বড় ধরণের কাজ নেয়া যায়৷

এই শিশুর সংসারের সংবাদ এবং অভাবের করুণবানী শুনে বুকের ভেতর হু হু করেছিল ঠিকই,কিছু করার ছিল না৷ এই একটি শিশুই নয়, অসংখ্য দারিদ্রপীড়িত পথশিশু এমন পাওয়া যাবে, যারা দিনমানে একবারও খেতে পায় না৷
আমাদের কি আসলে কিছুই করার নেই? উচ্চবিত্তরা এগিয়ে আসতে পারে না তাদের অভাব ঘুচাতে? রাস্ট্র কেন নজর দেয় না এদের দিকে৷ অনাহারে অর্ধহারে মরে যাওয়াই কি এদের নিয়তি?

Leave a Reply