নিশ্চই পশ্চিমায়ন-আন্দোলন সঞ্চালনের পেছনে বড় বড় শক্তির হাত রয়েছে, সেসবের মাঝে অন্যতম “জায়নবাদ”।
নিসন্দেহে মুসলিম জাতিগোষ্ঠী ও জায়নবাদের মধ্যকার প্রবলতর এ যুদ্ধের পটভূমিকা চিন্তাবৃত্তিক। কুরআনুল কারিম মুসলমানদের মাঝে যে ধর্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও উপলব্ধির সঞ্চার করেছিল, তা থেকে মুসলমানদের বহির্ভূত করার অভিলক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামে জায়নবাদ। ধর্ম-বহির্ভূত, মানবতা-বিবর্জিত করার এ নিরোভিসন্ধি — যার অপপ্রসার বিস্তৃত হচ্ছে চিন্তাশক্তিতে, অন্তঃকরণে — সম্পর্কে আমাদের সম্যক অবগতি প্রয়োজন।
১৪০০ বছরের দীর্ঘ পরিসরে আরবীয় ইসলামী সমাজব্যবস্থার আদলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও ভাষা যে সুপ্রকৃতি লাভ করে; সমাজবিদ্যা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইনশাস্ত্র যে উৎকর্ষ-মুখ পায়; এসব সুপ্রকৃতির বিকৃতি, ও উৎকর্ষতা অস্বীকার করে বিভিন্ন অভিযোগ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সন্দেহাতীত করার প্রচেষ্টা; এর পরিবর্তে বিকৃত মতবাদ সমূহকে প্রচার-প্রসার; জাহেলি পৌত্তলিকতা ও গোত্রতন্ত্রের অনুপ্রবেশ, যা ইসলাম চিরতরে নিঃশেষ করেছিল — এসবই জায়নবাদের মূলকার্যের খাতায় অন্তর্ভুক্তি পায়।
সার্বজনীন জায়নবাদ নিজেদের তৈরি প্রোটোকল সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকল বিধ্বংসী মতবাদকে স্বতত্বাবধানে গড়ে তুলতে থাকে। এসবের ফলে যখন মানবীয় মূল্যবোধ বিনষ্ট হবে, এটা নিজেদের কর্তৃত্ব-বিস্তারের ক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে।
তাদের এসব মতবাদের প্রারম্ভে থাকে ধর্মকে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথকীকরণ; আসমানী ধর্ম সমূহের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন ও সন্দেহাতীতভাবে উপস্থাপন; তদ্রূপ বিভিন্ন ভ্রান্তিজনক মতামত পোষণ; যেমন : মানুষ প্রথম যুগে একত্ববাদী ছিলোনা, বরং পৌত্তলিকতা ছিলো তার ধর্ম। পরে মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শের স্বরূপ একত্ববাদকে উদ্ভাবন করে। অথচ বাস্তব কখনও এমন নয়। মানব-পিতা আদম (আ.) একত্ববাদী ছিলেন। তাঁর থেকে ইসলাম পর্যন্ত কোন না কোন নবী/রাসূলের নবুওয়ত অবশিষ্ট ছিলো। ইসলামের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পরবর্তীতে আদর্শ-বিকৃতির কারণে মানুষ আসমানি ধর্ম ছেড়ে পৌত্তলিকতার সন্ধানী হয়। চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি, মূর্তি ও আলো-অধারের পূজায় নিমগ্ন হয়। বর্তমানের বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদের আহবানও এসবকে উপাস্য বানানোর পথে।
মোটকথা, আসমানি ধর্মসমূহ অবলম্বনের ফলে মানুষের মাঝে একত্ববাদ, নীতি-নৈতিকতা ভ্রাতৃত্ববোধ ও সমতাসহ আরো যেসব উৎকর্ষিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটতো; জায়নবাদ তার সম্পূর্ণ বিরোধিতায় মানুষদের প্রাণীত্ব ও প্রাচীন গুহা-যুগেই ফিরিয়ে দিতে চায়।
তাদের এসব কর্মকাণ্ডের বহু সুপ্ততথ্য বর্তমানে ফাঁস হয়ে যায়। তার মাঝে অন্যতম the protocols of the elders of zion। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে তার প্রণয়ন আরম্ভ হয়। ১৯০৫ সালে সার্জিয়াস পাইলোস প্রকাশ করে। এ সম্পর্কে মুসলমানদের অবগতি হতে হতে পঞ্চাশের দশক পেরিয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে নাকুলা হাদ্দাদ কিয়দাংশ অনুবাদ করে। পরে মোহাম্মদ খলিফা তিউনিসী আরবিতে পূর্ণ অনুবাদ শেষ করেন।
১৯৩১ সালে “নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড” পত্রিকায় তার সর্বপ্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হলে হেনরি ফোর্ড মন্তব্য করে বলেন, “বর্তমান বিশ্বে যা হচ্ছে, প্রোটোকল’স তার সত্যায়নকারী”।
এসব প্রোটোকল’সের মাধ্যমে বহু বাস্তবতা আমাদের সামনে দৃঢ়রূপে দৃশ্যমান হয়। এর অন্যতম, জায়নবাদীদের ৩০০ সদস্য, যারা সমগ্র বিশ্বে নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়। তেমনিভাবে এসব প্রোটোকলের মাধ্যমে জায়নবাদের সাথে ফ্রীম্যাসনের আঁতাত সম্পর্ক স্থাপন হয়। তাছাড়া নিজেদের কর্তৃত্বের পথ প্রসারিত করার জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহনের ব্যাপারেও তাতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার মাঝে অন্যতম, বস্তুবাদী মতাদর্শের সয়লাবের মাধ্যমে মানুষের চরিত্রবোধ ও ধর্মীয় মতাদর্শের হরণ। এর গড্ডালিকা প্রবাহে নিমজ্জিত করে বস্তুবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে তারা “উমামি”র ( যারা ইহুদি নয়, তাদের ক্ষেত্রে ইহুদিরা এ পরিভাষা ব্যবহার করে থাকে, তাদের দৃষ্টিতে “উমামি” প্রাণীর থেকেও নিকৃষ্ট) উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করবে।
আমরা যখন বিভিন্ন বিশ্বকোষ ও ইতিহাস-গ্রন্থে দৃষ্টিপাত করি দেখি যে, জায়নবাদ আরব, ইসলাম, ফিলিস্তিন ও ইবরাহীম (আ.) সম্পৃক্ত বিভিন্ন মৌলিক উপাত্ত মিথ্যা সাব্যস্তের ক্ষেত্রে বিকৃতির প্রাণপণ চেষ্টা করে।
যেহেতু প্রোটোকলগুলো ৫০ বছরের অধিক সময় ইসলামি বিশ্বের জ্ঞান-বহির্ভূত ছিলো। তাই ফিলিস্তিন ও কুদস নিয়ে সুলতান আব্দুল হামিদের স্পষ্ট কথামালাও সেরকম। কিন্তু যখন সত্য যখন উন্মোচিত হয়, আরব্য-ইসলামি ইতিহাসপটে পরিবর্তন ধরে। ফিলিস্তিন জবরদখল নিয়ে জায়নবাদের সব চক্রান্তের নথিপত্র ফাঁস হয়ে যায়। তাদের সব পরিকল্পনার দৃশ্যপট এক এক করে দৃশ্যমান হয়। এরকমই ভাবচিত্র ফুটে ওঠে জনৈক ঐতিহাসিকের কলমে : “ ইহুদি-সর্প জেরুজালেমের পথতিক্রমণের সময় কনস্টান্টিনোপলের পাশ ঘেঁষে যায়, ফলে শেষ হয়ে যায় উসমানী খেলাফত। কেননা তাছাড়া জেরুজালেমের পথ সংকীর্ণ ছিল, ইসরায়েল রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা ছিল দুঃস্বপ্নের”।
আব্দুল হামিদের সাথে তাদের অনেক বোঝাপড়া হয়। কিন্তু তিনি তাদের কুপ্রস্তাবে সাড়া দেননি। ফলে বিপল মনোরথে তারা ফিরে যায়। থিওডোর হের্জল তার দিনলিপিতে — যা জার্মান থেকে প্রকাশিত হয় — সুলতানের হুংকার বাণী এভাবে লিখে : হের্জলকে তোমরা জানিয়ে দাও যে, আমি আজকের পর থেকে তার সাথে এ — ফিলিস্তিন হস্তান্তর — ব্যাপারে কোন আলোচনাই করবনা। এ ভূমির এক বিঘতও কারো কাছে হস্তান্তরিত হবে, এটা আমি চাইনা। কেননা এটা আমার রাজকীয় সম্পত্তি নয়, বরং জাতিগোষ্ঠির মালিকানাধীন। তাই তোমাদের প্রস্তাবকৃত এ বিশাল অর্থকড়ি নিজেদের কাছেই রেখে দাও… ”।
জায়নবাদীরা সুলতানকে প্ররোচিত করতে চায় ৫০ মিলিয়ন স্টার্লিং পাউন্ডের লোভ দেখায়। কিন্তু তিনি তাদের কুপ্রস্তাবে সাড়া দেননি। এটাই উসমানী খেলাফতের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়।
নিসন্দেহে এ বাস্তবতার উদঘাটন বর্তমানের আরব্য-ইসলামি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভূলের সংশোধন হয়।
প্রোটোকলগুলোই সমগ্র বিশ্বে জায়নবাদের উদ্দিষ্ট বিভিন্ন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার ব্যাপারে আমাদের আজ্ঞাবহ করে। এরই সুস্পষ্ট আভাস আমরা প্রোটোকলে পাই : “আমাদের কর্তব্য হচ্ছে উমামীদের মাঝে অবক্ষয়ের স্রোত-প্রবাহ ধরিয়ে বিশৃঙ্খলার পথ উন্মোচন করা, ফলে তাদের শক্তিবর্ধক সবকিছুই দূর্বলতার ঘেরাটোপে ছেঁয়ে যাবে, আর আমাদের কর্তৃত্বের পথ সুগম হবে”।
অন্য প্রোটোকলে আছে, “আমরা তাদের সবাইকে কতিপয় ব্যাক্তিগত ও জাতীয় বিষয়ে বিশৃঙ্খলা-ধারায় লিপ্ত করবো। এটাই তাদের মানবীয় শক্তি নিঃশেষিত করার কাজ করবে। তাদের মাঝে ধরবে বিভক্তির চির। হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-ষড়যন্ত্রের ছড়াছড়ি হবে, দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ ও অভাব-অনটন”।
ইসলামি বিশ্বে বিভক্তি ও অনৈক্যের পথ উদ্ভাবনে জায়নবাদীরা হন্য হয়ে আছে। তাই মুসলমান ও আরবদের এসব ষড়যন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত হবে, চাই তা একতা- ভাতৃত্বের পথ ধরে হোক বা মতাদর্শ-মূল্যবোধ বিশুদ্ধির মাধ্যমে হোক।
নিসন্দেহে মুসলমানদের ধর্মতত্ত্ব, ভাষা ও ইতিহাস নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের ছোড়াছুড়ির লক্ষ্যমাত্র একটাই : মুসলমানরা বিভিন্ন মতাদর্শের ছুতোয় পৃথকীকরণ, যাতে ঐক্যের পথে তারা না ধরতে পারে। তাই আমাদের সজাগ-সতর্ক হতে হবে। তাদের মতিগতি, লক্ষ্য-অভিসন্ধির ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকেবহাল থাকতে হবে। তাদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের যথাযোগ্য সদুত্তর দিতে হবে। সকল ষড়যন্ত্র ও ছলনার ঘেরাটোপ ছিন্ন করে ইসলাম ও ইসলামি চিন্তাবৃত্তি সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে সকলে এক হতে হবে। সাথে থাকতে হবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির উপর্যুপরি ব্যবহার, আল্লাহর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস, তাঁর প্রতিশ্রুত সাহায্যের উপর পূর্ণ নির্ভরতা। অনুসন্ধিৎসা থাকতে হবে সে পথের যাতে আমাদের বিজয় চূড়ান্ত হবে। সত্যের পতাকা উড্ডীন হবে। প্রতিহত হবে জায়নবাদের সকল অপকৌশল।