মুহাম্মদ রাফে
হেফাজতে ইসলামের নাম শুনলে যে দুজন মানুষের কথা মুহূর্তেই স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাঁদের মধ্যে একজন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরি। এই কদিন আগেও যিনি কাঁপা কাঁপা গলায় সমস্ত জাতির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় নির্দেশনা দিতেন তিনি এখন বেঁচে নেই। এত এত জীবন্ত স্মৃতি, এত ত্যাগ-পরিশ্রমের ইতিহাস সব যেন কতদূর সরে গেল। জুনায়েদ বাবুনগরি সাহেব প্রথম দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন ২০১৩ সালের হেফাজতের ঐতিহাসিক আন্দোলনের সময়। সাংগঠনিকভাবে শরিয়াহর মৌলিক বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি এতো কঠোর আর নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন, কেউ তাঁকে সে মত থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার। শত বিপদ, ষড়যন্ত্র জেনেও শরিয়া বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অটল। আমাদের যুগে, বাংলাদেশের এই সময়ে এভাবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্টভাবে কথা বলার দ্বিতীয় কোন নজির নেই। এ এক দুঃসাধ্য ও কঠিনতম সংগ্রামের ইতিহাস।বস্তুত সাংগঠনিক পরিচয়-খ্যাতির পূর্ব থেকেই তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সমস্ত জীবন তিনি হাদিসের খেদমত করেছেন। সেই জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটাই ছিল তাঁর প্রধান ও অন্যতম পরিচয়। সাংগঠনিকভাবে ধর্মীয় কার্যক্রমের বাইরেও তাঁর যে এত বিপুল কার্যক্রম ও উদ্যোগ, তা অনেকেই জানেন না। অসংখ্য ছাত্র তাঁর থেকে হাদিসের সনদ নিয়েছে। সুগন্ধি মেখে শুভ্র পবিত্র জামা গায়ে জড়িয়ে যখন হাদিসের দরস দিতেন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হত। পবিত্রতার আবেশে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। বাংলাদেশের ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের অন্যতম ছিলেন তিনি।শরিয়াহর নির্দেশ হচ্ছে, হকের পক্ষে থাকতে হবে এবং বাতিলের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব রুখে দাঁড়াতে হবে। যারা গোটা মুসলিম জাতির মুখপাত্র হয়ে সত্যের পক্ষে ও অসত্যের বিরুদ্ধে পুরো জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, কোন পরাশক্তি যাদেরকে ন্যায়ের পথ থেকে টলাতে পারেনি, হাজারো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও যারা বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন দ্বীনের চিরন্তন ধ্বনি— বাংলাদেশের ইতিহাসে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আল্লামা আবুল হাসান রাহ, ও ফাতিমা খাতুনের ঔরসে তার জন্ম। তার নানা হারুন বাবুনগরীর বংশধারা সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে মিলিত হয়। ৫ বছর বয়সে তিনি বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে কোরআন হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি পাকিস্তান গমন করেন। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া বিন্নুরী টাউনে তাখাসসুস ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। ২ বছর গবেষণা করার পর তিনি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে হাদীস শাস্ত্রের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করে দেশে ফিরেন। তিনি পাকিস্তানে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী, ওয়ালী হাসান টুঙ্কী, ইদ্রিস মিরাঠী এবং বাংলাদেশে মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম, পিতা আবুল হাসান, আব্দুল আজিজ, শাহ আহমদ শফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ অসংখ্য খ্যাতিমান আলেমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের জন্য আব্দুল আযীয রায়পুরীর সান্নিধ্য লাভ করেন।১৯৭৮ সালের শেষ দিকে চট্রগ্রামের বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। সেখানে তিনি হাদীস শাস্ত্র সহ বিভিন্ন কিতাবের পাঠদান করতেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে বেশ কিছু দিন তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী পরিচালকও নিযুক্ত ছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদীস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব থাকলেও ২০২০ সালে শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী- এর ইনন্তেকালের পর তিনি আমীর নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে হেফাজত কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা দেওয়ার পর আহবায়ক কমিটির আমীর তাকেই বানানো হয়। সে অনুযায়ী নতুন কমিটি গঠন করে তিনি আমৃত্যু হেফাজতের আমীর ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।অন্যান্য ব্যস্ততার মাঝেও তার লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটির উপরে। তাছাড়া তিনি দেশ বিদেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিন, সাময়িকীতেও অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন।২০২১ সনের ১৯ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। আগের দিন থেকে শরীর অনেক খারাপ হয়। সকাল ১১ টা নাগাদ তাকে চট্রগ্রামের একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে দুপুর ১২:৩০ মিনিটে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জানা গেছে— মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তিনি স্ট্রোক করেছিলেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১:৩০ মিনিটে হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে লাখো জনতার উপস্থিতিতে তার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। হাটহাজারীর মাকবারায়ে জামিয়াতে তার গুরু আল্লামা আহমদ শফীর পাশেই তাকে দাফন করা হয়।আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন দ্বীনের দরদী একজন রাহবার, সত্যের অকুতোভয় সৈনিক। পুরোটা জীবন ব্যয় করেছেন ধর্মীয় কাজে। সেজন্যে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে। ২০১৩ সালের পর রিমান্ড শেষে জেল থেকে বের হয়ে তিনি শারীরিকভাবে অনেক খারাপ অবস্থা পার করেন। তবুও তিনি কখনো বাতিলের সাথে আপোষ করেন নি, অসত্যের সামনে নুয়ে যাননি। দরাজ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন— “মরতে পারি, তবুও দালালি করবো না”। তার ভক্তবৃন্দের দাবী— বাংলাদেশের দ্বীনি অঙ্গনে এই মহীরূহের বিয়োগের শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়।