লোকটির নাম আল হাকাম আমর ইবনে হিশাম। তৎকালীন কুরায়েশ বংশের একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, প্রভাবশালী এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। নবী মুহাম্মদ সঃ এর নবুয়ত লাভের পর থেকে তাঁর এবং ইসলামের প্রসারে সবচেয়ে বেশি বাধা বিপত্তি অত্যাচার কুৎসা ছড়ানো, নবী সঃ এর নামে বানোয়াট ও মিথ্যা ছড়ানোর কাজ গুলো যারা বেশি করেছিল তাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলো এই ইবনে হিশাম। তিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন, নবুয়ত বিশ্বাস করতেন, মুহম্মদ সঃ যে কখনো মিথ্যা কথা বলেননা এটাও মানতেন কিন্তু তাকে নবী হিসেবে মানতেন না।
ইবনে হিশামের যুক্তি ছিল- আমি শিক্ষিত, ধনী, প্রভাবশালী কিন্তু মুহাম্মদ এগুলোর কোনটাই না, তাহলে সে কিভাবে নবী হয়? আমাকে কেন নবী বানানো হলোনা! মূলতঃ এমন নিরর্থক চিন্তা, মিথ্যা বলার অভ্যাস এবং মনে মারাত্মক রকমের অহঙ্কারের কারণে সব সময় নবী মুহাম্মদ সঃ এর এবং ইসলামের চরম বিরোধিতা করতো। আর তাই শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোক হওয়া সত্ত্বেও তাকে তখন ডাকা হতো “মূর্খের পিতা” বা আবু জাহেল নামে!
আবু জাহেল সম্পর্কে মুহাম্মদ সঃ এর চাচা হলেও তিনি নবীকে এবং তাঁর সাহাবিদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রচুর নির্যাতন করতেন এবং অভ্যাসবশত সাজিয়ে গুছিয়ে নানা রকমের মিথ্যা কাহিনি ছড়াতেন। আবু জাহেল নবী সঃ এর মাথা ফাটিয়েছেন, নামাজে সিজদাহ্ রত অবস্থায় মৃত উটের পঁচা নাড়িভুড়ি তাঁর উপর ঢেলে দিয়েছেন! এরকম হাজারো রকমের অকথ্য অত্যাচার করেছেন।
আবু জাহেলের এসব অত্যাচারের জবাবে আল্লাহ্ সূরা আলাক এর আয়াত নাজিল করেছেন –
“আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে নিষেধ করে?এক বান্দাকে যখন সে নামায পড়ে?আপনি কি দেখেছেন যদি সে সৎপথে থাকে।অথবা খোদাভীতি শিক্ষা দেয়।আপনি কি দেখেছেন, যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন?কখনই না, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের চুলের গোছা ধরে হেঁচড়াবোই।মিথ্যাচারী, পাপীর চুলের গোছা।”(সূরা আলাক, আয়াতঃ ৯-১৬)
এখন প্রশ্ন হল, আবু জাহেলকে শাস্তি দিতে এখানে তার মাথার সামনের চুল ধরে হেঁচড়ানোর কথা কেন বলেছেন?ঘাড় ধরে, শিকলে বেধে, জিহবা টেনে ইত্যাদি আরো অনেক ভাবে শাস্তির কথা বলতে পারতেন!এর কারণটা জানতে আসুন সহজ ভাষায় সামান্য একটু মেডিকেল সাইন্স পড়ে দেখি-আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি যে, মানুষের মস্তিষ্ক কাজের উপর ভিত্তি করে প্রধান ৪টি ভাগে বিভক্ত। (ছবিতে দেখুন)।
পুরো মস্তিষ্কটি ডান-বাম দুই ভাগে বিভক্ত হলেও মূলত এই ৪টি ভাগের প্রত্যেকটিই আলাদা ভাবে তাদের কাজ করে।
★১) ফ্রন্টাল লোবঃ সামনের এবং সবচেয়ে বড় অংশ – সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা করা, কল্পনা করা, কোন কিছু বর্ণনা করা, গুছিয়ে রাখার ক্ষমতা, মানুষকে আকৃষ্ট করা, মিথ্যা কথা তৈরি করা, শরীরের নড়াচড়া করা, বিপদে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বিচার করার মতো কাজ গুলো করে এই অংশটি
।★২) পেরিয়েটাল লোবঃ কোন কিছু অনুবাদ করা, ভাষা বুঝা, শব্দ শুনে বুঝা যে এটা কিসের শব্দ, স্পর্শ করে বুঝতে পারা ইত্যাদি কাজ করে মস্তিষ্কের এই অংশটি।
★৩) টেম্পোরাল লোবঃ স্মৃতি ধারণ করা, মানুষের চেহারা চিনা, মৌখিক বিষয় মনেরাখা, কথাবার্তা শুনে মনে রাখা ইত্যাদি কাজ গুলো করে এই অংশটি।
★৪) অক্সিপিটাল লোবঃ লিখিত জিনিস পড়তে পারা ও মনেরাখা, রং চেনা, আলো আঁধার চেনা ইত্যাদি কাজ করে মস্তিষ্কের এই অংশটি।
আবু জাহেল সাবলীলভাবে কোন কারণ ছাড়াই প্রচুর মিথ্যা বলত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে অনর্গল ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা বলা একটি রোগ এবং এই ধরনের রোগীদের বলে প্যাথলজিক্যাল লায়ার (Pathological Lair)!আপনার আমার আশেপাশেই অনেক প্যাথলজিক্যাল লায়ার আছে। আসুন তাদের বৈশিষ্ট্য গুলো একটু দেখে নেই।
১) এরা খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলে।
২) খুব বড় বড় ধরনের মিথ্যা বলে। সামান্য মিথ্যা নয়!
৩) কোন কারণ ছাড়াই এবং স্বার্থ ছাড়াই মিথ্যা বলে।
৪) এমন কোন সত্য ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য মিশিয়ে মিথ্যা কথা বলবে যাতে সাধারণ মানুষ শুনলে খুব সহজেই তাদের বিশ্বাস হয়।
৫) নিজেকে কোন ঘটনার “হিরো” বানিয়ে নিজেকে খুব উচুমানের ব্যক্তি হিসেবে জাহির করবে।
৬) কখনো আবার নিজেকে কোন ঘটনার “শিকার” বানিয়ে আপনার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করবে।
৭) আপনার কারো সাথে সংঘাত থাকলে তাদেরকে জড়িয়ে/ আপনার অপছন্দের লোকদের নামে মিথ্যা কথা বলবে।
৮) তারা খুব অহংকার নিয়ে চলবে এবং অহংকার নিয়ে কথা বলবে এবং অন্যকে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলবে।
৯) আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবেনা বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দিবে।
১০) নিজের ভুল কখনোই স্বীকার করবেনা, মিথ্যা কথা বলবে। ইত্যাদি
আবারো আবু জাহেল; বদরের যুদ্ধে আবু জাহেল মারাত্মকভাবে আহত হয়ে যখন মুমূর্ষু অবস্থায় ময়দানে পড়েছিল, তখন আব্দুলাহ ইবনে মাসুদ রাঃ তার বুকের উপর চড়ে বসলেন। তখন আবু জাহেল চোখ খুলে তাকিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল– তুই মক্কায় উটের রাখাল ছিলিনা? আজ তো অনেক উচু সন্মানের জায়গায় উঠে বসছো হে!
এই প্যাথলজিক্যাল লায়ার বা বিকারগস্ত মিথ্যাবাদীদের বৈশিষ্ট্য গুলো এবং আবু জাহেলের জীবনী দেখলে বুঝা যায় যে সে একজন প্যাথলজিক্যাল লায়ার ছিল। কেননা এমন ধরনের মিথ্যুকরা তাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশকে ব্যবহার করে (ফ্রন্টাল লোব) মিথ্যা কাহিনি তৈরি করে এবং রটিয়ে বেড়ায়।আর তাই আল্লাহ্ তাকে তার কৃতকর্মের শাস্তির আভাস দিয়েছেন একজন প্যাথলজিক্যাল লায়ার হিসেবে। অর্থাৎ তার মাথার সামনের অংশের চুলের গুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবেন!বুদ্ধিমানদের জন্য কোরআনের প্রতিটি বাক্যের পিছনেই কোন না কোন জ্ঞানের উৎস রয়েছে।
ধন্যবাদ
মাসুদ আলম ১৪.০১.২০২০ ইউএই