মাওলানা আবু তাহের
কুরবানীর দিন কুরবানী করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত।(তিরমিজী শরীফ)
# কুরবানীর জন্তুর শরীরে যত পশম থাকে, প্রত্যেকটি পশমের পরিবর্তে একটি নেকী পাওয়া যায়।(মুসনাদে আহমাদ)
যাদের উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব
# সুস্থমস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্ক ও মুকিম নর-নারী যারা ১০ ই জিলহজ্জের ফজর থেকে ১২ ই জিলহজ্জের সন্ধা পর্যন্ত অর্থাৎ কুরবানীর দিনগুলোতে তাদের নিকট জীবনধারনের মৌলিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যতীত নেসাব পরিমাণ সম্পদ তথা বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বা সমমূল্যের সম্পদের মালিক হলে তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব।(ফতোয়ায়ে শামী: ৯/৫২০)# কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়। সন্তান, পিতা-মাতা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না। তবে তাদেও পক্ষ থেকে করলে তা নফল কুরবাণী হবে।(শামী ৯/৫২৪)
# যৌথ ব্যবসায়ী অথবা একান্নভুক্ত পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের আলাদাভাবে সম্পদের হিসাব করতে হবে। অতপর যাদের মালিকানায় নেসাব পরিমাণ সম্পদ হবে তাদের প্রত্যেকের উপর আলাদা আলাদা কুরবানী করা ওয়াজিব হবে।(দুররে মুখতার ৯/৫২৪)
# ব্যক্তিগত অলংকার বা অন্যান্য সম্পদ যদি নেসাব পরিমাণ হয় তাহলে পুরুষের মত নারীদের উপরেও কুরবানী ওয়াজিব হয়।(শামী ৯/৫২০)
# কুরবানী ওয়াজিব না হলেও নফল কুরবানী করলে কুরবানীর সাওয়াব পাওয়া যাবে।# যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় সে কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে সেই পশু কুরবানী করা তার উপর ওয়াজিব হয়ে যায়।(শামী ৯/৫৩২)
# কোন মাকসুদের(উদ্দেশ্য) জন্য কুরবানীর মান্নত করলে সেই মাকসুদ পুরণ হলে কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।# কেউ যদি ওয়াজিব কুরবানী আদায় করার জন্য পশু ক্রয় করে থাকে, কোন কারণে কুরবানীর দিন গুলোতে উক্ত পশু কুরবানী করতে না পারে। তাহলে উক্ত পশুটি জীবিত সদকাহ করতে হবে। আর যদি পশু ক্রয় না করে থাকে, তাহলে একটি বকরীর মূল্য সদকাহ করা ওয়াজিব।(শামী ৯/৫৩৩)
# ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে শর্ত হল ঋণটা জরুরতে আসলিয়ার জন্য হতে হবে, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য না হতে হবে। যদি ঋণ এ পরিমাণ হয় যে, তা আদায় করলে নেসাব বাকী থাকে না।(মুসলিম শরীফ ১৯৬৩)
কুরবানীর জন্তু প্রসঙ্গ
# উট, গরু, মহিষ, ভেড়া ও দুম্বা এই কয় প্রকারের গৃহপালিত জন্তু দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত আছে।(শামী ৯/৫৩৪)
কুরবানীর জন্তুর বয়স
# উট কমপক্ষে ৫ বৎসর হতে হবে। # গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বৎসর হতে হবে। # ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে পূর্ন ১ বৎসরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বৎসরের কিছু কমও হয় কিন্তু এমন হৃষ্ট-পুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বৎসরের মত মনে হয়। তাহলে তা দ্বারা কুরবানী করা যায়েয আছে। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।(শামী ৯/৫৩৪)
কুরবানীর জন্তুর স্বাস্থগত অবস্থা
# কুরবানীর পশু ভাল এবং হৃষ্ট-পুষ্ট উত্তম। # যে প্রানী এমন লেংড়া অথবা অতিশয় কৃশকায় ও দুর্বল যে, কুরবানীর স্থানে হেটে যেতে পারে না, তা দ্বারা কুরবানী হবে না। # যে পশুর একটিও দাঁত নেই তা দ্বারা কুরবানী হবে না। # যে পশুর কান জন্ম থেকেই নেই তা দ্বারা কুরবানী হবে না। # যে পশুর শিং মূল থেকে ভেঙ্গে যায় তা দ্বারা কুরবানী হবে না।(শামী ৯/৫৩৬,৩৭)
# যে পশুর উভয় চোখ অন্ধ বা একটি চোখ পূর্ন অন্ধ বা একটি চোখের পূর্ন দৃষ্টি শক্তি এক তৃতীয়াংশ বা তারচেয়ে বেশি নষ্ট তা দ্বারা কুরবানী হবে না। # যে পশুর একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তারচেয়ে বেশি কেটে গিয়েছে তা দ্বারা কুরবানী হবে না।(শামী ৯/৫৩৬,৩৭)
# ভাল পশু ক্রয় করার পর এমন দোষ ত্রুটি দেখা দিয়েছে যার কারণে কুরবানী দুরস্ত হয় না, এরুপ হলে ঐ পশুটি রেখে আরেকটি ক্রয় করে কুরবানী করতে হবে। তবে ক্রেতা গরীব হলে সেটাই কুরবানী দিতে পারবে।(শামী ৯/৫৩৯)
# বন্ধা পশু কুরবানী করা জায়েয আছে। # গর্ভপতী পশু কুরবানী করা যায়েজ। পেটের বাচ্চা জীবিত পাওয়া গেলে সে বাচ্চাও যবেহ করে দিবে। তবে প্রসবের নিকটবর্তী হলে সেরূপ গর্ভবতী পশু কুরবানী করা মাকরূহ।
শরীকের মাসায়েল
# একটি গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারবে। তবে কারও অংশ সাত ভাগের চেয়ে কম হতে পারবে না।(মুসলিম শরীফ ১৩১৮,শামী ৯/৫৩৬)# ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা একজনের পক্ষ থেকেই কুরবানী করতে হবে। # রসুলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার বিবিগণ ও বুযুর্গদের পক্ষ থেকেও কুরবানী হতে পারে।কুরবানীর পশু যবেহ করা প্রসঙ্গ# নিজের কুরবানীর পশু নিজেই কুরবানী করা উত্তম। নিজে যবেহ না করলে বা করতে না পারলে যবেহের সময় সামনে থাকা ভাল। মহিলাদের পর্দার ব্যঘাত হওয়ার কারণে সামনে না থাকতে পারলে ক্ষতি নেই।( বোখারী শরীফ ৫৫৫৮, শামী ৯/৫৪২)# যবাই করার পূর্বে প্রাণীকে ক্ষুধার্থ ও পিপাসিত রাখা জুলুম।(শামী ৯/৪৯৫) # কুরবানীর পশুকে মাটিতে কেবলামুখী করে শুইয়ে কুরবানীর দোয়া পাঠ করা উত্তম। কেউ দোয়া পড়তে না পারলে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে যবেহ করলেও চলবে।(আবু দাউদ ২৭৯৫, শামী ৯/৫০৩) # কুরবানীর পশু রাতের বেলাও যবেহ করা যায়েজ কিন্তু ভাল নয়।(শামী ৯/৫৩১)# কুরবানীর দাতা/দাতাগণের নাম মুখে উচ্চারণ করা বা কাগজে লিখে পড়া জরুরী নয়। আল্লাহপাক জানেন এটা কার কুরবানী। সে অনুযায়ীই তা গৃহীত হবে। # ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করা জায়েয নয়।(শামী ৯/৫৩৭)# যবাইয়ের মধ্যে জানোয়ারের চারটা রগ কাটতে হবে। তিনটা রগ কাটলেও দুরুস্ত আছে। তিনটার কম কাটলে সে জন্তু মৃত বলে গণ্য হবে এবং হারাম হয়ে যাবে। রগ চারটা এই: শ^াসনালী, খাদ্যনালী ও দুইটা শাহরগ।(শামী ৯/৪৯৩) # ধারালো ছুরি দ্বারা যবাই করা উত্তম। ভোঁতা বা কম ধারালো ছুরি দ্বারা যবাই করা মাকরূহ।(মুসলিম শরীফ ১৯৫৫, শামী ৪৯২) # যবাই করার পর জানোয়ার ঠান্ডা হওয়ার পূর্বে চামড়া খসানো, হাত-পা কাটা বা ভাঙ্গা কিংবা সমস্ত গলা কেটে দেয়া মাকরূহ।(শামী ৯/৪৯৫) গোস্ত বন্টনের তরিকা# অংশিদারগণ সকলে একান্নভুক্ত হলে গোস্ত বন্টনের প্রয়োজন নেই। অন্যথায় বন্টন করতে হবে।(শামী ৯/৫২৭)# অংশিদারগণ গোস্ত অনুমান করে বন্টন করবে না বরং বাটখারা দিয়ে ওজন করে বন্টন করতে হবে। অন্যথায় ভাগের মধ্যে কমবেশ হয়ে গেলে গোনাহগার হতে হবে।(শামী ৯/৫২৭) # অংশিদারগণ সকলে যদি সম্পূর্ন গোস্ত দান করে দিতে চায় বা সম্পূর্র্নটা রান্না করে বিলাতে চায় তাহলে বন্টনের প্রয়োজন নেই।(শামাী ৯/৫২৭)
কুরবানীর গোস্ত খাওয়া ও দান করার মাসায়েল#
কুরবানীর গোস্ত নিজে খাওয়া, পরিবার পরিজনকে খাওয়ানো, আতœীয় স্বজনকে দেয়া এবং গরীব মিসকিনকে দেয়া সবই জায়েজ। মুস্তাহাব ও উত্তম তরীকা হল তিন ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখা, একভাগ আতœীয় স্বজনকে দেয়া এবং একভাগ গরীব মিসকিনকে দান করা।(মুসনাদে আহমাদ ১৬২১০,শামী ৯/৫৪১) # তবে যার পরিবারে এতবেশি লোক যে, সম্পূর্ন গোস্ত হলে কোন রকম একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে তাহলে তার জন্য সম্পূর্ন গোস্ত রাখাই মুস্তাহাব। এই কারণে সমাজে তিনভাগের একভাগ দেয়ার ব্যপারে তাহাকে চাপদেয়া বা কটু কথা বলে কষ্ট দেয়া বা লজ্জিত করা ঠিক নয়।(শামী ৯/৫৪২)
# এমন কুরবানীর গোস্ত যাহা ফকির মিসকিনদেরকে সদকাহ করা ওয়াজিব যেমন: মান্নতের কুরবানী, মৃত ব্যাক্তির অসিয়তের কুরবানী, বিগত বছরের কাজা কুরবানী ইত্যাদির গোস্ত কোন বিধর্মীকে দেয়া বৈধ নয়। তবে এমন কুরবানীর গোস্ত যাহা সদকাহ করা ওয়াজিব নয় তাহা হিন্দু বা যে কোন বিধর্মীকে দিতে শরীয়তে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।# কুরবানীর গোস্ত বা বিশেষ কোন অংশ যেমন: মাথা, পা ইত্যাদি পাশ্রমীক হিসাবে দেয়া জায়েয নয়।(শামী ৯/৫৪৩) # কুরবানীর গোস্ত শুকিয়ে বা ফ্রীজে রেখে দীর্ঘদিন খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই।(মুসলিম শরীফ ১৯৭২,১৯৭৩)
যেই সমস্ত অংশ খাওয়া হারাম যথা: ১. প্রবাহিত রক্ত, ২. পুরুষ লিঙ্গ, ৩. অন্ডকোষ, ৪. স্ত্রী লিঙ্গ, ৫. জমাট রক্ত, ৬. মূত্রথলী, ৭. পিত্তথলীআক্বিকার মাসায়েল# একই পশুর ভিতর কুরবানী ও আক্বীকাহ জায়েয আছে। # যে জন্তু দ্বারা কুরবানী জায়েয তা দ্বারাই আক্বুীকাহ জায়েয। # ছেলে হলে আক্বীকায় দুইটি বকরী বা ভেড়া উত্তম, আর মেয়ে হলে একটি বকরী বা ভেড়া। কিংবা কুরবানীর বড় পশু অর্থাৎ গরু, মহিষ বা উটের মধ্যে হলে ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দেয়া উত্তম। # সন্তান জন্মের সপ্তম দিবসে তার সুন্দর অর্থবহ নাম রাখা, তার মাথা হলক করে চুল ওজন করতঃ ঐ পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার মূল্য সদকাহ করা এবং আক্বীকাহ করা মুস্তাহাব। # তবে আক¦ীকার মান্নত করলে ওয়াজিব হয়ে যাবে যেমনঃ কেহ বলল যে, আমার পুত্র সন্তান হলে গরু দিয়ে আক্বীকাহ করব। অতপর পুত্র সন্তান হলে ১টি গরু দ্বারা আক্বীকাহ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। আর মান্নতের আক্বীকার গোস্ত নিজেও খেতে পারবে না এবং কোন ধনী ব্যাক্তিকেও দিতে পারবে না। সম্পূর্ন গোস্ত গরীব মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা ওয়াজিব। আর সাধারণ আক্বীকার গোস্ত নিজেও খেতে পারবে এবং পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ সকলেই খেতে পারবে। # বালেগ হওয়ার পরও আক্বীকাহ করা যায়। তবে দ্বিতীয় বার আক্বীকাহ করা জায়েয নাই। # আক্বীকার পশুর চামড়ার মূল্য দান কওে দেয়া উচিৎ।কুরবানীর পশুর চামড়া সম্পর্কিত মাসায়েল# কুরবানীর পশুর চামড়া দান করে দিবে। তবে শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে নিজেও ব্যাবহার করা জায়েয। কোন ধনী ব্যাক্তিকে হাদিয়া দেওয়াও জায়েয। তবে তাহা বিক্রয় করলে তার মূল্য দান করা ওয়াজিব। (মুসতাদরেকে হাকেম ৩৪৬৮,শামী ৯/৫৪৩) # কুরবানীর চামড়ার মূল্য মসজিদ মাদরাসার নির্মান কাজে বা অন্য কোন নেক কাজে খরচ করা জায়েয নাই। দানে ই করতে হবে। তবে গরীব আতœীয় স্বজন, এতিম এবং মাদরাসার ছাত্রদেরকে দিলে দ্বি-গুন সাওয়াব পাওয়া যাবে।(শামী ৯/৫৪৩) # কুরবানী দাতার জন্য সরাসরি কুরবানীর মূল্যই সদকাহ করা ওয়াজিব। মূল্য দ্বারা কোন কিছু ক্রয় করাতঃ সদকাহ করা জায়েয হবে না।(শামী ৯/৫৪৩)(আক্বীকাহ, কুরবানীর দো‘আ ও তাহা পড়ার নিয়ম এবং ঐ সংক্রান্ত জরুরী মাসলা মাসায়েল স্থানীয় হক্বানী ওলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে।)(তথ্য সূত্রঃ বুখারী, মুসলিম, মুসতাদরেকে হাকেম, মুসনাদে আহমাদ, ফাতওয়ায়ে শামী, ফাতওয়ায়ে আলঙ্গিরী, ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া, আহকামে যিন্দেগী কুরবাণীর পাথেয়।)