উমাইয়া খেলাফতের সময়কার কথা। তখন খলিফা ছিলেন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। খলিফার সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সময়টি ছিলো এমন যখন মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো। ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রাণঘাতী সংঘাতে লিপ্ত ছিলো মুসলিম সম্প্রদায়। ইসলামী খেলাফতেও তখন দেখা দিয়েছিলো ভাঙ্গন। ইসলামী খেলাফত সিরিয়া ও মিশরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) ইরাক ও হিজাযে স্বাধীন হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। আব্দুল্লাহ (রাঃ) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রাঃ) এর মেয়ে আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) এর ছেলে। তিনি উমাইয়া খেলাফতের আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানান যার দরুন উমাইয়া শাসকের সাথে তাঁর দেখা দেয় সংঘাত। .
উমাইয়া শাসকরা আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) এর শাসনের পতন ঘটানোর জন্য প্রথমে ইরাকে সেনাভিজান চালায়। ইরাক কব্জা করার পর পবিত্র হিজাযেও সৈন্য প্রেরন করে এবং আক্রমণ চালায় মক্কা শরীফে। উমাইয়া শাসকের উভয় অভিযানের সেনাপতি ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মদিনা শরীফের অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার জন্য হাজ্জাজ বাইতুল্লাহ শরীফের উপরও মিনজানিক থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে বাইতুল্লাহ শরীফের ইমারত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) জুলুমের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে শাহাদাৎ বরন করেন। .
উতপ্ত দুপুরে একটি দেহকে ক্রুশবিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মৃতদেহটি সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রাঃ) এর। ক্রুশে চড়ানোর আগে শিরশ্ছেদ করা হয়। উল্লাস করছিল আশপাশে জড়ো হওয়া সেনারা। সেদিন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রাঃ) লড়েছিলেন বীরের মতো, পরাজিত করেছিলেন অসংখ্য লোককে। কিন্তু তাকে থেমে যেতে হলো যখন তার শত্রুরা তার উপর পাথর ফেলে, কিন্তু মাটিতে পড়ে গিয়েও তিনি লড়ছিলেন। তারা তার পা কেটে ফেললো এবং অবশেষে তাকে হত্যা করলো। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) এর মৃতদেহ কয়েকদিন পর্যন্ত চৌরাস্তায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। কিছুদিন আতিবাহিত হওয়ার পর সৈন্যরা হাজ্জাজের কাছে গেল, বলল, “অনেক দিন তো হলো, উনার লাশ নামানো দরকার।”হাজ্জাজের উত্তর ছিল, “আল্লাহর কসম, আসমা আমার কাছে ভিক্ষা না চাইলে আমি নামাবো না তার লাশ।”আসমা (রাঃ) এ কথা শোনার পর বললেন, “আমাকে নিয়ে চলো আমার ছেলের লাশের কাছে।”তিনি ছেলের লাশের কাছে গিয়ে দোয়া করলেন এবং দোয়া শেষ করবার পর বললেন, “সময় কি হয়নি আল্লাহর বীরসেনাকে তার ঘোড়া থেকে নামাবার?”এ কথা হাজ্জাজের কানে আসবার পর তার এত নিচু অনুভব হয় যে লজ্জায় তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের (রাঃ) মৃতদেহ নামিয়ে আনেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রাঃ) ছাড়াও জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) এবং কুমাইল ইবনে জিয়াদ (রাঃ)- শাহাদাতবরণ করেন। .
পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা মালিক বিন মারওইয়ান হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে হেজাযের গভর্নর নিয়োগ করেন। নির্মম ও কঠোর দমননীতির কারণে জালেম ও অত্যাচারী শাসক হিসেবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তার চরম ঘৃণাকারীরাও আবার তাকে বুদ্ধিমান, বিশুদ্ধভাষী আর চমৎকার বক্তা হিসেবে অভিহিত করেন। হাসান বসরী (রঃ) এর পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফই ছিলেন সেরা বক্তা। এই অত্যাচারী আর খুনী ভদ্রলোক কিন্তু একই সাথে ছিলেন কুরআনের হাফেজ। প্রতি রাত তার কাটতো কুরআন পড়ে পড়ে। এমনকি আজকের যুগে অনারব মুসলিমরা যে কুরআন পাঠ করছে সহজভাবে, এর কৃতিত্ব হাজ্জাজ বিন ইউসুফের, কারণ তিনিই আরবি অক্ষরগুলোর সাথে নুকতা চিহ্নগুলো যোগ করেন কুরআনে! এছাড়াও সামরিক কমান্ডারদের বাছাইয়ের সময় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কঠোর নীতি অবলম্বন করতেন। সৈনিকদের র্যাঙ্কের ক্ষেত্রে তিনি শৃঙ্খলা আরোপ করেন। এর পদক্ষেপ মুসলিম সাম্রাজ্যের দূর বিস্তৃতিতে সহায়ক হয়েছিল। তিনি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল আরবিতে অনুবাদের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন এবং প্রথমবারের মত তিনি খলিফা আবদুল মালিককে মুসলিম বিশ্বের জন্য বিশেষ মুদ্রা চালুর ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হন।.
খলিফা আব্দুল মালিক একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দুনিয়াতে এমন কেউ নেই যে নিজের দোষ জানে না। তোমার কি দোষ আছে নিজের কোনো?” হাজ্জাজ বললেন, “আমি বিবাদ সৃষ্টিকারী, বিদ্বেষ পোষণকারী আর হিংসুক।” খলিফা বললেন, “শয়তানেরও তো এত খারাপ দোষ নেই বুঝি যা তোমার আছে। মনে হয় তোমার আর শয়তানের মাঝে আত্মীয়তা আছে পিতার দিক থেকে।”.
ইবনে কাসির (র) হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সম্পর্কে বলেন, “হাজ্জাজের যেসব কাজ আমরা নিশ্চিত জানি তার মাঝে তার রক্তপাত ঘটানো প্রধান। এটিই আল্লাহর কাছে তার শাস্তি পাবার জন্য যথেষ্ট। তবে সে জিহা(দে)র কাজে ও নানা শহর জয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। সে কুরআন চর্চায় অনেক বেশি খরচ করতো। যখন হাজ্জাজ মারা যায়, তখন তার মাত্র ৩০০ দিরহাম ছিল।”.
ভালোর তালিকায় নাম যাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের, নাকি তার নাম লেখাতে হবে খারাপের তালিকায়? এ বিতর্ক চলেছে বহুদিন। কোন কোন ইমাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কাফের বলেছেন আবার কেউ কেউ বলেছেন সে কাফের নয় তবে জালেম শাসক ছিলো। হাজ্জাজ ছিলেন একজন অত্যাচারী শাসক, রক্তপিপাসুও বলা উচিত। তার নানা অভিযানে প্রায় এক লাখ থেকে সোয়া লাখ মানুষ মারা যায়, এবং এ কারণে পারস্য ও আরবের কুখ্যাত চারজনের তালিকায় তৎকালীন সময়েই তার নাম উঠে যায়, যারা কি না লক্ষাধিক মানুষ মেরেছেন। ইরানের প্রখ্যাত লেখক আল-সালাবী সে তালিকাটা করেছিলেন। কিন্তু জেনে অবাক হতে হবে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার দৃঢ় শাসনের জন্য বহুল বিদিত, কঠোরভাবে তিনি রাজ্যশাসন করতেন- নিয়মের যেন কোনো ব্যত্যয় না হয় কোথাও।
জীবনের শেষভাগে এসে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যে হত্যাকাণ্ডটি করেন সেটি ছিল বিখ্যাত সাইদ ইবনে জুবাইরের। তিনি হাজ্জাজের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এ বিদ্রোহ দমনের পর সাইদ পালিয়ে যান মক্কায়, কিন্তু তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় হাজ্জাজের দরবারে। হাজ্জাজ নির্দেশ দিলেন সাইদের শিরশ্ছেদ করতে। সাইদ বলেছিলেন, “হাজ্জাজ! মহান আল্লাহর দরবারে আমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হব!” এবং তিনি হাসলেন। হাজ্জাজ হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সাইদ বললেন, “আমার প্রতি তোমার হিংসা আর তোমার প্রতি আল্লাহর ধৈর্য দেখে হাসছি।” সাইদ তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পাঠ করেন, প্রথমবার স্পষ্ট শোনা যায়, পরের দুবার অস্পষ্ট। তার মাথা গড়িয়ে পড়লো।
এরপরই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পাগল হয়ে যান। যখনই তিনি ঘুমাতেন, ঘুমের মাঝে সাইদকে দেখতেন, যেন তিনি তার সমস্ত কাপড়চোপড় আঁকড়ে ধরছেন আর বলছেন, “হে আল্লাহর দুশমন! তুমি আমাকে কী জন্য হত্যা করলে?” হাজ্জাজ পাগলের মতো বলতেন, “হায়রে! আমার আর সাইদের মাঝে কী হলো!” হাসান বসরীর কাছে সাইদ ইবনে জুবাইরের হত্যার সংবাদ পৌঁছানোর পর তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! হে পরাক্রমশালীদের চূর্ণ-বিচূর্ণকারী! হাজ্জাজকে তুমি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দাও!” হাসান বসরী (রঃ) ছিলেন তাদের একজন যারা হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হোক চাইতেন না। তার মতে, হাজ্জাজ একটা গজব, তলোয়ার দিয়ে গজবের মোকাবেলা হয় না। কাজেই, ধৈর্য ধরে প্রার্থনা করতে হবে। সাইদকে হত্যার এক মাসের মাঝে এবং হাসান বসরির কাছে সাইদ ইবনে জুবায়ের এর হত্যার সংবাদ পৌঁছানোর তিনদিনের মাঝে হাজ্জাজ মৃত্যুবরণ করেন। এ খবর হাসান (রঃ) জানার পর খুশিতে সিজদায় পড়ে যান।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শেষদিককার বাণী ছিল, “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও! কারণ, জনগণ ধারণা করে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না। জনগণ আমার আশা কেড়ে নিতে চায়, কিন্তু তোমার প্রতি আমার আশা কখনোই হারাবে না।”এ ব্যাপারে হাসান বসরি (রঃ) বলেন, “আল্লাহর কসম, যদি হাজ্জাজ নাজাত পায়, তবে এ দোয়ার দ্বারাই পেয়ে যাবে।”
প্রবল রক্তপাতকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কখনো সাহাবী-হন্তারক নামে ঘৃণিত, আবার কখনো সিন্ধু বিজয় আর তার কুরআন-প্রেমের জন্য প্রশংসিত। ইতিহাসের পাতায় বিতর্কিত শাসকেদের অন্যতম একটি নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।