সর্বক্ষেত্রে আমেরিকা নিজেকে বিশ্বনেতৃত্বের নিয়ন্তা মনে করে এবং সর্বক্ষেত্রে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের অগ্রগণ্য মনে করে। কিন্তু কোভিড ১৯ এর সংকট আমেরিকায় পরিবেশ অস্থিতিশীল করে রেখেছে। বিশেষত শতকরা ৪৩ জন লোক হেলথ কভারেজ প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত নয়। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট অংশের লোকদের লাগামহীন ভোগবিলাস এবং অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সে সংকটকে আরো ভয়াবহ করছে। উনিশ শতকের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ স্বরচিত গ্রন্থ “ডেমোক্রিটি ইন আমেরিকা”তে আমেরিকাকে একাধিকবার “বীকন অব ভেলুস” ও “মডেল অব মডেলস” বলে অবহিত করেন। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় সেসব সংকট আরো ছায়াবাহী হয়। যার ফলশ্রুতিতে বলতে হয়, আমেরিকান সাম্রাজ্য পতনোন্মুখ।
শেষের কয়েক বছরে, আরো বিশেষভাবে বললে, মৃত্যু ও বন্দী জীবনের দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ও মাসে আমেরিকান সমাজব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আসে। এমনকি কোভিড ১৯ সংকট শুরু হওয়ার প্রারম্ভে আমেরিকার মধ্যমমানের লোকদের বিশ্বাস ছিলো যে, অসমতার অগ্রহণীয় মাত্রা লোকদের মাঝে বিরাজ করছে, তাই একটি উন্নতশীল রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যিকভাবে কল্যাণমূলক নতুন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ ও আরো সামাজিক নিয়মবদ্ধতার দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তাই নাগরিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে সাড়া দেওয়ার জন্য নতুনভাবে সামাজিক চুক্তি প্রয়োজন, যারা নতুন করোনা-সংকট মোকাবেলায় নিজেদের অনিরাপদ বা অনিয়ন্ত্রিত মনে করে। কিন্তু সামাজিক ও স্বাস্থগত দূর্বলতার মৌলিক কেন্দ্রবিন্দু ছাড়াও আমেরিকান প্রশাসন বিপুল মানবক্ষয় ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যার দ্বারা তাদের বিশ্বনেতৃত্বের সক্ষমতা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আমেরিকার উত্থান ও পতন
১৮৯৯ সালে ফিলিপাইনে সামরিক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আমেরিকার বিশ্বকতৃত্ব শুরু হয়। কিন্তু সে পরিসরকে আমরা ১৭৮৯ সাল থেকে ধরে ২৩০ বছরও বলতে পারি, যখন জর্জ ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ হয়। কেননা তখনই আমেরিকার সর্বপ্রথম সরকার গঠন হয় এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় তৈরি হয়। যাই হোক না কেন, এই দীর্ঘ দুই দশক সময়ে জেমস কে. পোলাকের “মেনিফেস্টো ডেসটিনি”র প্রতি বিশ্বাস, কংগ্রেসে জেমস মোর্ণ’র ইউরোপ সম্পর্কিত ভাষণ, ওয়েলসন কর্তৃক প্রণীত চৌদ্দ মূলনীতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে শান্তি-শৃঙ্খলার উদ্দেশ্য যা প্রণীত হয়, অথবা ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে ব্রেল হার্বো’র পর রুজভেল্টের “স্পিচ অব ইমফানি” বা কুখ্যাত ভাষণ — এসব থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থানকে পৃথক করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের স্বল্প সময় পর জর্জ ডাব্লিউ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণার পর এখনো দুই দশক অতিবাহিত হয়। এ মৌলিক মুহুর্তগুলোতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র মৌলিকভাবেই বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ ছিলো।
এর বিপরীতে কোভিড ১৯ মোকাবেলায় আমেরিকা প্রশাসনের মোকাবেলার ধরণ এ রকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নেয়া যায়না। সুতরাং এ বিশ্বশক্তির জন্য সংকট প্রতিরোধে যেকোনো দিক থেকে প্রতিরোধমান হওয়া সম্ভব নয়। যার ধারাবাহিকতায় তারা সামগ্রিকভাবে মহামারীর যথাযোগ্য নির্মূল করার ক্ষেত্রে অক্ষম প্রতিপন্ন হবে। বিশ্বনেতা হয়ে তা প্রতিরোধ করার সর্বজনীনতা থাকবেনা। তাই এ সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন এই সংকটের কার্যকরী মোকাবিলা না করত পারলে আমেরিকা ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বের এজেন্ডা নির্ধারনী নেতা হিসেবে তার অবস্থান হারাবে৷
বর্তমানের নতুন সময় পরিসরে আমেরিকার কর্মকাণ্ডের মূলধারা হচ্ছে, তাদের বিরতিহীন — অন্য ভাষায় বললে — অবিদ্যমান বা বিরল কর্তৃত্বের মহড়া দান, যা সংকট চলাকালে ট্রাম্পের নির্দেশনাসূচক বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় । শেষ দিকের আমেরিকার বহির্রাজনীতির প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক এবং অনেকক্ষেত্রে গোলযোগপূর্ণ। তাই অবস্থার বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাদের অনুসন্ধান শক্তি ও বিষয়বস্তু নির্দিষ্টকরণের সক্ষমতার উপর বর্তাবে। আর এই নীতিনির্ধারণী যার মোকাবেলায় আমেরিকার কূটনৈতিক শক্তি সর্বস্ব, হয়তো তাদের যুগের স্বতসিদ্ধ নিয়মনীতির বাগডোরে আবদ্ধ করবে অথবা নতুন মূল্যবোধ প্রণয়ণে বাধ্য করবে, যা শাক্তির দিক থেকে বিভিন্নভাবে সমর্থিত এবং গতিশীলতার ক্ষেত্রে অনন্য।
একুশ শতকে এসে আমেরিকা বিভিন্ন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের নিজেদের ব্যর্থতা ও পর্যদুস্ততার প্রমাণ দিয়েছে। এর মধ্যে সন্ত্রাসরিবোধী যুদ্ধ এবং নতুনভাবে যুক্ত হলো করোনা-সংকট। এ উভয়ই তাদের ভূমি আক্রান্ত করে দূর্বলতার পয়েন্টগুলোকে আমাদের সামনে ধরিয়ে দিতে সক্ষম। বিশেষত করোনা মোকাবেলায় আমেরিকা প্রশাসন সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেনি। বরং তারা পূর্বের চিরাচরিত মাধ্যমগুলোকেই ব্যবহার করে, যা বর্তমান সংকট মোকাবেলায় পূর্বের চেয়ে এখন আরো বেশি অদক্ষ। কোভিড ১৯ এর মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করে, তাকে কমানো বা তা থেকে দায়মুক্তির ক্ষেত্রে একরকম ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেয়। এখন পর্যন্ত সে সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। যা ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলাকালীন নিহত লোকদের চেয়ে ৬০% হারে বেশি। কখনো বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সামরিক লোকদের সংখ্যাও ছাড়িয়ে যাবে। এ হল এক অবস্থান। দ্বিতীয়ত তাদের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধেও সাংঘর্ষিক ব্যাপ্তি নতুনতরে বাড়ছে। যেমনটা আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। পক্ষান্তরে সিরিয়া তাদের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ভয়াবহ অবস্থানের সম্মুখীন হয়েছে, সেখানে এখন তাদের উদাসীনতা দৃশ্যমান হচ্ছে।
সংকট চলাকালীন নতুনভাবে বিশ্বনেতৃত্বের প্রয়োজন
একুশ শতকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক নিয়মনীতিতের নিয়ন্ত্রণ থেকে আমেরিকা সরে আসতে চায় না। তদ্রূপ তারা এটাও চায় না যে, তাদের বৈশ্বিক সমুন্নত অবস্থান বিদূরিত হোক। কিন্তু এতে করে যে রাজনৈতিক ঝক্কি-ঝামেলা পোহানো ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রয়োজন, তার দায়ভারও নিতে অনাগ্রহী এবং এই বিশ্বব্যাপী গোলযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে ঐতিহাসিক প্ররোচনার নতুন দিগন্ত খুলতে চায়। ট্রাম এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সর্বস্ব হয়ে আছে। কিন্তু এ বিশ্বময় গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আমেরিকার বিশ্বপ্রতিভু হিসেবে কাজ করার কোন ইচ্ছাধিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম যে, আমেরিকা বিশ্বাশাসনের কর্তৃত্ববাদী কোন দায়বদ্ধতা থেকে হাত গুটিয়ে নিলো।
কোভিড ১৯ এর কারণে বিশ্বপরিক্রমায় সামগ্রিকভাবে যে সংঘাত আসে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বৈশ্বিক আন্তঃসংযোগের প্রক্রিয়ায় সংকট দেখা যাচ্ছে, তদ্রূপ ইউরোপীয় ইউনিয়নে সংহতি ও দৃঢ়তাবন্ধনের ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং সর্বশেষ অনেক অঞ্চল গোলযোগের দিকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসরমান হচ্ছে। এ জটিলতার প্রতিরোধে সম্ভবতঃ বৈশ্বিক আন্তঃসংযোগের ক্ষেত্রে সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মনীতির অনুরূপ হবে। যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিনিধিত্ব করেছিল ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টাফালিয়া চুক্তি, ১৭৯২ ও ১৭৯৮ সালে বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ের চুক্তিসমূহ এবং ১৮১৪ সালে সংগঠিত ভিয়েনার সম্মেলন। তার থেকে আরো বেশি প্রতিনিধিত্ব হয়, স্নায়ুযুদ্ধের প্রারম্ভে বিশ্বের বড় বড় শক্তিসমূহের একত্রকরণ, যার প্রত্যেকে আশপাশের ছোট রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা সমর্থিত ছিলো। তাই বর্তমানে তিন সুপার পাওয়ার শক্তির সম্মেলিত অর্থনৈতিক শক্তি বর্তমানের সংকট-পরবর্তী সময়ে সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টার পরিধি নির্ধারণ করবে। যদিও চীন ২০৩০ থেকে ২০৫০ এর মধ্যবর্তী সময়ে নিজেদের বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের ধাঁচে স্বৈরাচারী জাতীয়তাবাদ উদ্ভাবন করা। তখন এ ঝুঁকি দৃশ্যমান হবে যে, ট্রাম্পিয়ান রাজনীতি দীর্ঘ পরিসরে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য বিশ্বের জন্য মূল হয়ে দাড়াবে এবং বিশ্বায়ন যুগের শেষ পরিসমাপ্তি টেনে আনবে, নব্বইয়ের দশক থেকে আমরা যে ব্যাপ্তি অতিবাহিত করেছি। তখন এটা আমেরিকার জন্য বিরাট কষ্টযোগ্য কাজ হবে এবং বৈশ্বিক আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের একতরফাবাদকে রাজনৈতিক, বানিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের দিকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করবে। যার কারণে আমেরিকা ও বিশ্ব নতুন ও প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের প্রবক্তা হবে, যা ইতিমধ্যে নিজেদের আদর্শবাদ বিচ্যুতি প্রশাসনিক বরখেলাপী ও সীমাতিক্রমী কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিচ্যুত করার ব্যর্থচেষ্টায় নিমজ্জিত করেছে।
সংকট-পরবর্তী আমেরিকার পদক্ষেপ
যখন এ সংকট কাটিয়ে উঠবে এবং নিহত লোকজনের সমাধিস্থ করা হবে, নতুনভাবে আমেরিকার রাজনৈতিক কর্মনীতির এজেন্ডাসমূহ নিরীক্ষণ করতে হবে৷ এবং এ সংকট তাদের ভাগে এমন এক হিসাবের মালা ঝুলিয়ে দিবে, যা শুধু পররাষ্ট্রনীতির সাথেই সম্পৃক্ত নয়, বরং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সাথেও যুক্ত হবে। তাতে অবশ্যই মৌলিক দিক থেকে অর্থনৈতিক সংশোধনী এবং সমাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। অধিকন্তু বৃহৎ পরিসরের বিভিন্ন শিল্পকর্ম, ছোটখাটো সংস্থাগুলোকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাচানোর জন্য “রুজভেল্টে’স নিউ ডিয়াল” এর মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। চলমান করোনা-সংকট দূরীকরণের ক্ষেত্রে এটাই তাদের অন্যতম সাড়াদানের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে৷
এ মহামারী এবং তার প্রভাবসমূহ কার্যকরীভাবে আমেরিকান যুগের সমাপ্তিকে নিশ্চিত করে। পরিবর্তনের এ দৃশ্যমান সময়ে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে এটাই বিবেচিত হচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সমগ্র বিশ্বে জাতীয়তাবাদের ইন্ধন যোগাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের বিশ্বাস যে, আমেরিকার ডেমোক্রিটি অধিক স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অর্থনীতি অধিক ন্যায়সঙ্গত — এটা খর্ব হচ্ছে। অথচ তাদের এই বিশ্বাসই অনুপম সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপ্তি দেখায়। যা কষ্টসাধ্য কর্মনীতিতে ওয়েবারের প্রোটেস্টেন্ট নৈতিকতার ফলশ্রুতিযুক্ত রূপ। আর এর মাধ্যমে তাদের পুঁজিবাদী চেতনারও সন্দেহজনক অবস্থান তৈরি হচ্ছে।