২০১২ সালে বলিউড নায়ক আমির খান তার মা জিনাত হুসেনকে নিয়ে হজ্জে যান। আমির খানের মা হুইল চেয়ারে বসা ছিলেন। তিনি মায়ের হুইল চেয়ার ঠেলে মাকে হজ্জ করতে সহযোগিতা করেন।
ঠিক একই সময় হজ্জ করতে যান পাকিস্তানের দুই বিখ্যাত দাঈ- মাওলানা তারিক জামিল (হাফিজাহুল্লাহ) ও জুনায়েদ জামশেদ (রাহিমাহুল্লাহ)। মাওলানা তারিক জামিল একজন দা’ঈ হিশেবে সারা বিশ্বে বিখ্যাত। তিনি মানুষকে দ্বীনে ফেরানোর জন্য, অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিয়ে যান। তাঁর দাওয়াতের মেথোডলজি হলো তাঁর একটি কথার মতো-
“মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বিলাও। ঘৃণা তো আগে থেকেই বিরাজমান।”
মাওলানা এবার টার্গেট করলেন আমির খানকে ইসলামের দাওয়াত দিবেন। আমির খান যেহেতু হজ্জ করতে এসেছেন, তার মন-মানসিকতা দাওয়াতের উপযোগী, এই সময়ই তাকে দাওয়াত দিলে সেটা কার্যকর হতে পারে।
একজন দা’ঈ সবসময় সুযোগ সন্ধানী। তিনি মানুষের জন্য পেরেশানবোধ করেন, নিজে কিভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচবেন এবং মানুষকে কিভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবেন এই নিয়েই তিনি সর্বদা ভাবেন। মানুষকে জাহান্নামে প্রেরণ নয়, জাহান্নামে যাওয়া থেকে আটকানোই থাকে তার লক্ষ্য।
কিন্তু, ভারতের একজন স্টার অভিনেতার সাথে ইচ্ছে করলেই তো আর দেখা করা যায় না। এর জন্য প্রটোকল লাগে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার হয়। মাওলানা তারিক জামিল মধ্যস্থতার জন্য পাকিস্তানের ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদির সহযোগিতা নিলেন। দাওয়াতের ময়দানে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কারো কাছে দাওয়াত দিতে গেলে তার পরিচিত কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান বা তার মাধ্যমে যান। এতে করে তার কাছে পৌঁছানো সহজ হয়।
মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য আমির খানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ দেয়া হয় মাওলানা তারিক জামিলকে। তিনি সাথে নিয়ে যান (এক সময়ে পাকিস্তানের বিখ্যাত রকস্টার, পরবর্তীতে যিনি দ্বীনে ফিরেন) জুনায়েদ জামশেদকে।
মাওলানা তারিক জামিল কলেজ লাইফ পর্যন্ত দ্বীনদার ছিলেন না। আর দশজন মুসলিম তরুণের মতো ছিলেন, দ্বীন সম্পর্কে জানাশোনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস এতোটা ছিলো না। গান নিয়ে মজে ছিলেন। মুভি দেখতেন, মুভির খবর রাখতেন।
আমির খানের সাথে যখন তাঁর সাক্ষাৎ হলো, তখন আমির খান বেশ আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। কখন জানি মাওলানা বলে উঠেন- ‘এসব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দ্বীনে ফিরো, নতুবা জাহান্নামে যাবে’! মাওলানা তারিক জামিল আমির খানের চেহারা দেখে এমনটাই আঁচ করেন।
বলিউডের অন্যতম সেরা নায়কের সাথে বিশ্বের অন্যতম সেরা দা’ঈর কথোপকথন শুরু হলো। মাওলানা ইসলাম নিয়ে কোনো কথা না বলে কথা শুরু করলেন মুভি নিয়ে। ১৯৬০-১৯৭২ সালের বলিউডের (বুম্বাই) মুভির ইতিহাস পর্যালোনা করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, এই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে তিনি যতোটা জানেন, আমির খান ততোটা জানেন না। তিনি আলাপ শুরু করলেন নায়ক দিলিপ কুমার, রাজ কাপূর, মেহবুব সাব, মদন মোহনের।
আমির খানের চক্ষু চড়কগাছ! তিনি অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন একজন মাওলানা তার সাথে ফিল্ম নিয়ে কথা বলছেন। তার ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে সেই মাওলানা তারচেয়েও বেশি জানেন! (মাওলানার এই জ্ঞান ছিলো তার কলেজ বয়সের জ্ঞান)
এভাবেই কেটে যায় ৩০ মিনিট। মাওলানা বললেন, “সময় তো শেষ।” আমির খান বললেন, “তাহলে আসুন, ডিনার করে নিই।”
খাওয়া-দাওয়া শেষে স্বাভাবিক হতে লাগলো আরো প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট। এখনো মাওলানা ইসলাম নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি। আমির খানের সাথে যখন মোটামুটি ভাব জমলো, আমি খান যখন বুঝতে পারলেন যে, মাওলানা দুজন তাকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য আসেননি, ঠিক সেই মুহূর্তে মাওলানা তারিক জামিল একটি প্রস্তাব করেন-
“আমির ভাই, আপনি তো আপনার মাকে নিয়ে হজ্জ করতে এসেছেন। আপনাকে কি আমি শুনাবো কিভাবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হজ্জ করেছেন?”
আমির খান খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, “জ্বি, শুনান।”
মাওলানা নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হজ্জের ঘটনাগুলো শুনাতে থাকলেন, আমির খান গালে হাতে দিয়ে সুবোধ বালকের মতো বসে শুনতে লাগলেন। তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। কোনো নড়াচড়া করলেন না। মাওলানা তারিক জামিল প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট আমির খানকে নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনা শুনালেন।
এই ঘটনা উল্লেখ করে মাওলানা একটি ওয়াজে মন্তব্য করেন-
“মানুষ ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত। আর আপনারা মানুষকে ভালোবেসে কাছে না টেনে ফতোয়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন।”
৩০ মিনিটের জন্য দেয়া সাক্ষাৎকার ৩ ঘন্টায় গিয়ে শেষ হয়। আমির খান সময়টা খুব উপভোগ করেন। মাওলানারা যখন চলে যাচ্ছেন, তিনি ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে শুধু বিদায় দেননি, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
যাবার সময় মাওলানা জিজ্ঞেস করেন, “হজ্জের পর আমরা আবার দেখা করি?” আমির খান বললেন, “জ্বি অবশ্যই।”
হজ্জ শেষে আমির খান চলে যান মদীনায়। মাওলানা ম্যাসেজ করে দেখা করার জন্য বললে তিনি জানান যে, তিনি মদীনায়। মাওলানা মদীনায় যান তার সাথে দেখা করতে। দেখা করার জন্য আমির খান যে সময় দিলেন, সেই সময়ে তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক ঘন্টা গেলো এলেন না। দুই, তিন ঘন্টা গেলো, তবুও এলেন না। মাওলানার সাথে থাকা জুনায়েদ জামশেদ অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “চলেন তো, যাই!”
কিন্তু, মাওলানা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ৬ ঘন্টা পর যখন আমির খান এলেন, তখন মাওলানা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি, কোনো রকমের বিরক্তি প্রকাশ করেননি। এভাবেই তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। মাওলানা নিয়মিত আমির খানের সাথে যোগাযোগ রাখেন, আমির খানও মাঝেমধ্যে তাঁকে ফোন দেন।
মাওলানা এখানে আরেকটি টেকনিক শেখান; যেটা তিনি সবসময় অনুসরণ করেন। সেটা হলো- কাউকে আগে কল দেবার আগে তাকে ম্যাসেজ দেয়া- ‘আপনি কি ফ্রি আছেন? কল দেবো?’ ম্যাসেজে ইতিবাচক সাড়া পেলে তবেই ফোন দেন, নতুবা সেই ব্যক্তি ফোন দেয় (একান্ত ইমার্জেন্সি কারণ ছাড়া এভাবেই অনুমতি নেয়া উচিত)।
আমির খানের সাথে মাওলানা তারিক জামিলের দাওয়াতের গল্পটি বলার পর তিনি একটি প্রচলিত প্রবাদ বলেন-
“একজন মদ্যপ, নেশাগ্রস্থকে (Drunk) ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া সহজ, কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা একজন মদ্যপকে টেনে তোলা অনেক কঠিন।”
এই কথাটি বেশ ওজনদার। একজন পাপী ব্যক্তিকে তার পাপের জন্য গালাগালি করা, অভিযুক্ত করা বেশ সহজ। কিন্তু, তাকে তার পাপের পথ থেকে বাঁচিয়ে আনা, উদ্ধার করাটা বেশ কঠিন। আমরা এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ‘সহজ’ কাজটি করি। কোনো পাপীকে ভালো করার চেষ্টা না করে উল্টো তার পাপের জন্য কী শাস্তি হতে পারে তার লিস্ট ধরিয়ে দিই, পারলে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিই!
আরিফুল ইসলাম
১১ জুলাই ২০২১
ফুল বয়ান দেখতে