গীবত: একটি পর্যালোচনা

আসিফ আহমাদ

কাকে বলে গীবত
গীবত একটি আরবি শব্দ। বাংলায় ‘পরনিন্দা বা পরচর্চা’।অভিধান আমাদের জানাচ্ছে-
“الغيبة ان تذكر اخاك من وراءه بما فيه من عيوب يسترها ويسوؤه ذكرها”
অর্থাৎ,কারো অগোচরে তার মধ্যে বিদ্যমান কোন দোষ-ত্রুটির আলোচনা করা; যে ত্রুটির আলোচনা সে অপছন্দ করে এবং গোপন করতে চায়। (আল-মুজামুল ওয়াসিত)
আমরা অনেকে মনে করি, বিদ্যমান ত্রুটির আলোচনা বৈধ।অবৈধ হচ্ছে এমন দোষের আলোচনা যা তার মধ্যে বিদ্যমান নয়। অথচ ব্যাপারটি এমন নয়।বরং কারো মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটির আলোচনাই গীবত; যা অবৈধ।আর অবিদ্যমান দোষে দোষারোপ হচ্ছে অপবাদ; যা আরও মারাত্বক।
হাদিস শরীফে এসেছে; আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবীজি (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! গীবত কী? নবীজি (সাঃ) বললেন, তোমার ভাইয়ের এমন আলোচনা যা সে অপছন্দ করে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যদি এমন কিছু বলি যা তার মধ্যে বিদ্যমান!?
নবীজি ইরশাদ করলেন,“তার মধ্যে বিদ্যমান দোষের আলোচনাই তো গীবত।আর যে দোষ তার মধ্যে নেই তাতো অপবাদ।” (আবু দাউদ)
গীবত করা হারাম
গীবত করা একটা মারাত্বক মন্দ স্বভাব। এর মন্দত্ব ও কুপ্রভাবের কারণে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ভঙ্গিতে একে নিষিদ্ধ করেছেন এবং এর মন্দত্ব বর্ণনা করেছেন।পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
ولا يغتب بعضكم بعضا. ايحب احدكم ان ياكل لحم اخيه ميتا فكرهتموه. وتقوا الله. ان الله تواب الرحيم.
অর্থাৎ, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়াময়।(হুজুরাত:১২)
এই আয়াতের তাফসিরে মুফতি শফি (রঃ) লিখেছেন, উল্লিখিত আয়াতে তিনটি বিষয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তন্মধ্যে গীবতের নিষিদ্ধতা অতি গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে এবং একে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সমতুল্য প্রকাশ করে এর নিষিদ্ধতা ও নীচতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।(মারেফুল কুরআন)


যেসব ক্ষেত্রে গীবত জায়েয
গীবত একটি মারাত্বক কবীরা। এর মন্দ প্রভাবও অনেক বিস্তৃত।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্র এমন আছে,যেসব ক্ষেত্রে গীবত করার অবকাশ শরীয়ত কতৃক অনুমোদিত। বসÍুত এসব ক্ষেত্রগুলো নিষিদ্ধ গীবতের অন্তর্ভূক্ত নয়। মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি (রঃ) তাঁর তিরমিজি শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ তুহফাতুল আলমায়িতে এমন ছয়টি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন;
১) মাযলুমের জন্য এমন কারো নিকট যুলুমের অভিযোগ করা যার থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা করা যায়।
২) কোন নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিবর্তন এবং কোন অবাধ্যকে সঠিক জন্য আনার জন্য গীবত করা।
৩) ফতোয়া হাসিল করতে কারো গীবত করার প্রয়োজন হলে।
৪) মুসলমানদের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে গীবত করা।যেমন, একবার একব্যক্তি নবীজি (সাঃ) এর নিকট আসার অনুমতি চাইলে নবীজি (সাঃ) সাহাবিদের বললেন; তাকে আসতে দাও।সে তার কওমের সবচেয়ে খারাপ লোক।(মুত্তাফাক আলাইহি)
এমনিভাবে জয়িফ রাবির দোষত্রুটি আলোচনা করা।
৫) কারো লকবের (উপনাম) মধ্যে যদি কোন ত্রুটির বিষয় থাকে যা তার পরিচয় তুলে ধরে, তাহলে পরিচয়ের জন্য তা বলা জায়েয।(তুহফাতুল আলমায়ি,৫:২৭৬ সংক্ষেপিত)

উপরের আলোচনা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, মুসলিম জনসাধারণকে বাতিল ফিরকার ব্যাপারে সচেতন করা গীবত নয়।বরং বিভিন্ন বাতিল ফিরকার ভুল চিন্তাধারা ও বিচ্যুতি তুলে ধরা উলামায়ে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ ব্যাপারে নবীজি (সাঃ) বলেছেন; এই ইলমকে পরবর্তীদের নির্ভরযোগ্যরা অর্জন করবে; যারা বাড়াবাড়িকারীদের বিকৃতি ,বাতিল মতাদর্শীদের প্রতারণা ও মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে এই ইলমকে রক্ষা করবে।(মিরকাত; ১: ৪৬৩)
সুতরাং সামষ্টিকভাবে উলামায়েকেরাম কোন বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর ব্যাপারে সতর্ক করাতে তাদের নিজস্ব কোনো স্বার্থ নেই। উম্মতের কল্যানকামিতায় বাধ্য হয়ে তারা বাতিল ফিরকা ও ভুল চিন্তাধারার ভ্রান্তিগুলো তুলে ধরেন। এটি কল্যানকামিতা। শুধু আলেমগণ নন; বরং উম্মতের প্রতিজন সদস্যের উপর সাধ্যানুযায়ী অপর মুসলিমের জন্য কল্যানকামীতা জরুরি।
নবীজি (সাঃ) বলেছেন; দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামীতা। তাকে জিগ্যেস করা হল, “কার জন্য”? তিনি উত্তর দিলেন, “ আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রাসুলদের জন্য, মুসলমানদের ইমাম এবং সর্বসাধারণের জন্য।”(মুসলিম:১০০)

Leave a Reply