লেখক:মাওলানা বোরহানউদ্দীন
হাদীস জগতে ইমাম আবু হানীফার শ্রেষ্ঠত্ব সমকালীন যুগ থেকে নিয়ে সর্বযুগেই স্বীকৃত ছিলো।সেকালের মুসলিম উম্মাহর বড় বড় মনিষীগণ হাদীস বিষয়ে তার অসাধারণ কৃতিত্বের কথা অবলীলায় স্বীকার করে গেছেন।রিজাল শাস্ত্রের কিতাব সমূহ দেখলে বুঝতে পারবেন হাদীস শাস্ত্রে তাঁর কি পরিমাণ জ্ঞান ছিলো।তার জ্ঞান গর্ব দেখে তাঁর উস্তাযরা পর্যন্ত তার প্রতি মায়া জড়ানো দৃষ্টিতে তাকাতেন,যেমন: খতীব আল বাগদাদি লিখেছেন হারেছ ইবনে আব্দুল্লাহ সুত্রে, তিনি বলেন, كنا نكون عندعطاءبعضناخلف بعض،فإذاجاءأبوحنيفة أوسع له وأدناه
আমারা আতা রহঃ এর হাদিসের মজলিসে সারি সারি হয়ে বসতাম,যখন আবু হানিফা আসতেন,তখন তিনি তার জন্য রাস্তা প্রশস্ত করে দিতেন,এবং তাকে কাছে এনে বসাতেন,(তাঁর প্রতি উস্তাযের এমন আচরণ তার বিরল প্রতিভার কারণেই ছিলো,) হাদীস সংকলনের জন্য তিনি দেশ হতে দেশান্তরে সফর করেছেন,শত শত রাত বিনিদ্রায় পার করেছেন।অতঃপর হাজার হাজার হাদীস থেকে তিনি নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতাব লিখেছেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ভরা হৃদয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে, এযুগে তাঁর কিছু সমালোচক এ কথা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,যে আবু হানিফা হাদীস জানতেন না,তার ব্যপারে এমন কথা সত্যিই হাস্যকর,আর নিচু মানষিকতার পরিচায়ক,তাদের এমন মন্তব্যের জবাবে কিছু লিখতে বসলেও কলম লজ্জায় ভেঙে পড়ে।কারণ হাজার হাজার হাদিস থেকে যিনি নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতাব লিখেছেন তার ব্যপারে এমন কথা লেখা যে “তিনি হাদিস জানতেন”আসলেও লজ্জার।তারপরেও এ বিষয় নিয়ে তৎকালিন যুগের নির্ভরযোগ্যে ইতিহাসবিদদের কিছু মতামত তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (রহ.)‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে লিখেন, الإمام فقيه الملة،عالم العراق،أبوحنيفة….وعني بطلب الآثار،وارتحل في ذالك، ‘ইরাকের আলেম ফকীহুল মিল্লাত ইমাম আবু হানীফা (রহ.)..। যিনি হাদীস ও আছার সংগ্রহের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন এবং এর জন্য সফর করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা,খ: ৬পৃ:৩৯০-৯২)
অন্যত্র হাফেয যাহাবী (রহ.) বলেন, إن الإمام أباحنيفة طلب الحديث،وأكثرمنه في سنة مئةوبعدها ‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণ করেছেন। একশ’ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে তিনি হাদীস সংগ্রহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ: ৬পৃ: ৩৯৬)
আবু হানীফা (রহ.) হাদীস অন্বেষণের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কতটা অগ্রগামি ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তারই সমকালীন সহপাঠী ইমাম মিসআর বিন কেদাম (রহ.) এর কথা থেকে। তিনি বলেন, طَلَبنا مَعَ أَبِي حَنِيفَةَ الْحَدِيثَ ، فَغَلَبَنَا وَأَخَذْنَا فِي الزُّهْدِ . আমি আবু হানীফা (রহ.)-এর সাথে হাদীস অন্বেষণ করেছি, তিনি আমার থেকে আগে বেড়ে গেছেন। তাঁর সাথে যুহদে (আল্লাহর ইবাদত) লিপ্ত হয়েছি, সেখানেও তিনি অগ্রগামী হয়ে গেছেন। (মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ: ২০; মানাকেবে আবী হানীফা, পৃ: ২৭) এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, মিসআর বিন কেদাম এমন একজন হাদীস বিশারদ যার ব্যাপারে হাফেয আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী (রহ.) বলেন, কোনো হাদীস নিয়ে যখন ইমাম শো’বা (১৬০হি.) ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)(১৬১হি.)-এর মাঝে মতানৈক্য হতো তখন তারা সে হাদীসের ব্যাপারে মিসআর বিন কেদামের সিদ্ধান্তানুযায়ী সমাধানে উপনীত হতেন। ইমাম শো’বা ও সুফয়ান সাওরী (রহ.)-কে বলা হয় ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস’। তাদের মতো হাদীস বিশেষজ্ঞ যে মিসআর বিন কেদামকে সমাধানের মাধ্যম ও পাল্লা বানান, সেই মিসআর বিন কেদাম ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি আমার থেকে হাদীস সংগ্রহে আগে বেড়ে গেছেন!! তাহলে হাদীসের জগতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মর্যাদা কত ওপরে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। ( ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ: ১৬৬,)
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) দেশ দেশে সফর করে যে পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ করেছেন তার পরিমাণ হলো ৪০ হাজার। এই ৪০ হাজার থেকে সহীহ ও আমলযোগ্য আহকামের হাদীসগুলো বাছাই করে তিনি একটি হাদীসের কিতাব লিখেন, যার নাম কিতাবুল আছার। এ বিষয়ে সদরুল আইম্মা মুয়াফফাক বিন আহমদ (রহ.) লিখেছেন, انتخب ابو حنيفة رحمه الله تعالى الآثار من اربعين الف حديث. আবূ হানীফা রহঃ চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে ‘কিতাবুল আসার’ লিখেছেন (মানাকিবে ইমামে আ’যম,১/৯৫) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কত্তান রহ. বলেন, إن أبا حنيفة -والله- لأعلم هذه الأمة بما جاء عن الله ورسوله. আল্লহর কসম আবু হানিফা এ উম্মতের সবচেয়ে বেশি কোরআন সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন,(ইমাম ইবনে মাজার আওর ইলমে হাদীস৫৬)