ইসলামী তরবিয়তের উসুল (১)

অনুবাদ:আসিফ আহমাদ


সন্তানের ইসলামী তরবিয়ত ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানে প্রথম যে উসুল ও মূলনীতির উপর আমাদের আমল করতে হবে, তা হলো-“দ্বীনদার জীবনসঙ্গী নির্বাচন।“
কারণ, আজ আপনি যে মেয়েটিকে বিয়ে করছেন, আগামীতে তিনি হবেন আপনার সন্তানের মা। আর প্রত্যেক শিশুর প্রথম শিক্ষালয় হচ্ছে তার আপন মায়ের কোল।
এজন্য মায়ের দায়িত্ব যে তার কলিজার টুকরা সন্তানকে একেবারে শুরু থেকেই উত্তম আদব কায়দা শেখাবে। শিশুর স্বভাব চরিত্র ও আচার-আচরণ সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হবে। শিশুর কোমল মনে ইসলামের সঠিক বীজ বপন করবে, যা এক সময় ফুলে-ফলে সুশোভিত এক মহীরুহে পরিণত হবে।
তাই শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় তার জন্য একজন ‘আদর্শ মা’ নির্বাচন করা। এজন্যই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فاظفر بذات الدين
Seeঅর্থাৎ, দ্বীনদার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে সফল হও।
একজন আরব কবি বলেছেন, الام مدرسه اذا اعددتها
اعددت شعبا طيب الاعراق
অর্থাৎ, মা শিশুর জন্য শিক্ষালয়, যদি তুমি এই শিক্ষালয় প্রস্তুত করতে পারো, তবে তুমি উত্তম বংশ তৈরি করলে।

আজকে যারা শিশু, আগামীতে তারাই হবে কান্ডারী। আগামীতে তারা হবে জানবাজ মুজাহিদ, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দায়ি, উম্মতের সংশোধনকারী মুসলিহ, মুসলিম উম্মাহর রাহবার চিন্তাবিদ।
আর এই কাফেলা তৈরীর জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন একজন ‘দরদী মা’। কারণ তিনিই সন্তানের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভরসাস্থল এবং শিক্ষা ও চিন্তা নির্মাণে প্রথম স্কুল।
এজন্য অভিভাবকরা যখন ছেলেদের জন্য পাত্রী খুঁজবেন, তখন সাধ্যমত উত্তম গুণাবলীসম্পন্ন মেয়েকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক শিক্ষা দীক্ষা ও বেড়ে ওঠার জন্য এটি অন্যতম বুনিয়াদ। কারণ সন্তান মায়ের কোলেই বড় হবে। মায়ের চিন্তা চেতনা তার মগজে স্থায়ী বাসা বাঁধবে।
তাই আমরা বলি, সন্তানের তরবিয়ত ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার জন্য একজন উত্তম চরিত্রের নম্র ভদ্র মা নির্বাচন করা। ‘এমন মা’ যিনি দ্বীন ও দুনিয়া বুঝে হেফাজত করতে পারবেন।
আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব যে, পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা বা কীর্তি সম্পাদনের পেছনে সম্পাদনকারীর মা-বাবার নিরব ভূমিকা অথবা তরবিয়তের অসামান্য অবদান ছিল।
শিশুর প্রতিপালন
শিশুর প্রতিপালনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার অন্যসব পদ্ধতি থেকে ইসলামের পদ্ধতি একেবারেই আলাদা। ইসলাম জন্মের পর থেকেই শিশুর সঠিক মানসিক গঠন ও বিকাশের গুরুত্ব দেয়। আর এর জন্য ইসলাম পিতা-মাতার উপর শিশুর তরবিয়তের ভার ন্যস্ত করেছে। শিশু প্রতিপালনের এই শিক্ষা আমাদের রব ও আমাদের নবীজি আমাদেরকে শিখিয়েছেন ।এর মধ্যে তিনটি বিষয় জন্মের পর পরই পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের আদায় করতে হয়।
এক
জন্মের পরপরই বাচ্চার দুই কানে আযান ও ইকামত বলা । এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিশু পৃথিবীতে প্রথম যা শুনবে তা যেন আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদ ও বড়ত্বের আওয়াজ হয়।
কেননা আল্লাহ তায়ালাই তাকে নুতফা থেকে মাংসপিণ্ড, এরপর পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। যাতে পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও আদম আলাইহিস সালাম ‘আল্লাহর আনুগত্যের’ যে অঙ্গীকার করেছিলেন শিশুর দুই কানে আযান সে আনুগত্য প্রকাশের প্রথম পদক্ষেপ।
যেহেতু শিশুর দুই কানে আযান দেওয়া নবীজির সুন্নত, তাই এই দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায়। যেন বান্দা ঘোষণা করছে, হে আমার রব! জীবনের সব মুহূর্তে আনন্দ কিংবা দুঃখে তোমার কথা মেনে চলবো। ইসলামের বিশ্বাসের উপর অটল থাকবো। আর আমার পরিবারও যেন এই পথেই অটল থাকে।
এরপর শিশুকে দেখে বলবে-‘تبارك الله احسن الخالقين
বরকত পূর্ণ আল্লাহর নাম যিনি উত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেন।
এরপর এই দোয়া পড়বে-
ربنا اوزعنا ان نشكر نعمتك التي انعمت علينا وعلى والدينا وان نعمل صالحا ترضاه واصلح لنا في ذريتنا -وانبنا إليك وانا من المسلمين
অর্থাৎ, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এবং আমাদের পিতা মাতার উপর যে নেয়ামত দান করেছেন তার শুকরিয়া আদায় করার তৌফিক দান করুন এবং আমরা যেন এমন নেক আমল করি যাতে আপনি রাজি হন। আমাদের জন্য আমাদের সন্তানদেরকে সংশোধন করুন। আমরা আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি আর আমরা আপনার অনুগত।
দুই
এরপর পিতা-মাতার উপর গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হচ্ছে শিশুর একটি সুন্দর ইসলামী নাম রাখা। আবু নুয়াইম তার হিলয়া নামক গ্রন্থে নবীজি (সাঃ) এর হাদিস উল্লেখ করেছেন, حق الولد على الوالد ان يحسن اسمه ويعلمه الكتاب ويزوجه إذا بلغ
অর্থাৎ, বাবা-মায়ের উপর সন্তানের হক যে, বাবা-মা তার একটি সুন্দর নাম রাখবে, কিতাব ও সুন্নাহর তালিম দিবে এবং বয়স হবার পর তার বিবাহের ব্যবস্থা করবে।
এছাড়াও ইতোপূর্বে আমরা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হাদিস জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সন্তানের হক হচ্ছে তার সুন্দর নাম রাখা হবে এবং উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হবে।

একটি সুন্দর নামের গুরুত্ব অনেক। তাছাড়া নামের প্রভাব ব্যক্তির উপর পড়াটা স্বীকৃত। সুন্দর একটি নাম শিশুর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এর জন্য ওলামায়ে কিরাম শিশুদেরকে মন্দ উপাধি বা নামে ডাকতে নিষেধ করেন। কারণ, এর দ্বারা বাচ্চার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামপূর্ব যুগের রাখা অশুদ্ধ বা খারাপ অর্থবোধক নাম পাল্টিয়ে সুন্দর নাম রেখে দিতেন। একটি সুন্দর অর্থবহ নামের গুরুত্ব এর দ্বারা বোঝা যায়।
তিন
শিশুর জন্মের পর বাচ্চার জন্মের খুশির এবং নবীজির সুন্নত পালনার্থে আকিকা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সপ্তম দিনে একটি বকরি বা সাধ্যমতো এর চেয়ে বড় কোন পশু জবাই করা।এ উপলক্ষে নিজের প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব দেরকে দাওয়াত দেওয়া।
আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত, তাঁর অনুগ্রহের শুকরিয়া স্বরূপ এই আকিকা করা হবে। শিশুর জন্মের পরপর এই তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
চলবে,ইনশাআল্লাহ।

Leave a Reply