জামাল হামাদান রাহেমাহুল্লাহ তার নৃতত্ত্বের উপর এ গ্রন্থ লিখলেও তাতে প্রাসঙ্গিকভাবে অনেক কিছু জড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বিশ্বে ইহুদিদের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে তিনি তাদের ডায়াসপোরিক ইতিহাস উল্লেখ করেন। এতে মাত্র কয়েক পাতায় তিনি ইহুদি-ইতিহাসের ধারাবাহিক পরিসর উল্লেখ করেন। এরপর উল্লেখ করেন ইহুদিদের জাতিগত বিভক্তি । ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যাতত্ত্ব ও জাতিতত্ত্ব এবং সর্বশেষে নৃতত্ত্ব। বইটি খুব সংক্ষেপে। পড়তে গেলে আগে ইহুদিদের সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে জানতে হবে। নতুবা পড়া অনর্থক হবে। তাই অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাকে অনেক বেগ পোহাতে হচ্ছে জায়গামত টীকা-সংযোগের ক্ষেত্রে। এখানে পাঠ-সংক্ষেপ লেখার ক্ষেত্রে আমি তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করিনি। যেহতু পাঠ-সংক্ষেপ, প্রয়োজন মনে করছি না। আসুন মূল আলোচনার দিকে
★★★
জায়নবাদীদের দাবী-দাওয়া মৌলিকভাবে দুই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত, ইহুদিরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়। তার চূড়ান্ত মাত্রা জার্মানিতে নাৎসিদের হাতে নির্যাতন। এ পৌরাণিকার মাধ্যমে তারা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের দয়াদ্র দৃষ্টি লাভ করে। দ্বিতীয়ত, তাদের ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে, কেননা বনী ইসরায়েলের ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর নিজেদের বংশীয় খাঁটিত্ব অটুট রেখেছে। তারা তাওরাতে বর্ণিত বনী ইসরায়েলের সরাসরি বংশধর। তারা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্বাচিত। ফিলিস্তিন তাদের আল্লাহ কর্তৃক দেয়া প্রদত্ত প্রতিশ্রুত ভূমি।
তাদের এ মিথ্যা দাবী ভিত ধ্বংসের জন্য জামাল হামাদান ১৯৬৭ সালে এনথ্রোপলজি অব জিউস নাম্নী গ্রন্থ প্রকাশ করেন ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তিনি এখানে সাব্যস্ত করেন যে, বর্তমান পৃথিবীর ৯৫% ইহুদি মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা ফিলিস্তিন থেকে নির্বাসিত ইহুদিদের বংশধর নয়। আমরা এখানে পরিচ্ছেদ আকারে সে গ্রন্থের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করবো :
- প্রাচীন ইতিহাস
ইহুদিদের আলোচনা শুরু হয় বনী ইসরায়েলের মাধ্যমে। আর বনী ইসরায়েলের আলোচনার শুরু হয় আবুল আম্বিয়া ইব্রাহিম আ. এর মাধ্যমে। তিনি খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করতেন। হিজরতের মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনের হুরান অঞ্চলে আসেন। এখানে থাকাকালীন সময়ে ইসহাক আ. এবং তার থেকে ইয়াকুব আ. জন্মগ্রহণ করেন। ইয়াকুব আ. এর মাধ্যমে তাওরাত ও ইতিহাসে বারো প্রজন্মের সূত্রপাত হয়।
যখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনে পৌঁছে, তখন সেখানে কেনানীরা বসবাস করতো। উভয়পক্ষের সংঘাতদ্বন্দ্বে সময় কাটে। একপর্যায়ে যুদ্ধ ইবরানীদের ( তারা বনী ইসরায়েলী, অতিবাহিত হওয়া আরবি “উবুর”। তারা নদী পার হয়ে কেননীদের সাথে যুদ্ধ করেছিল, এজন্য তাদের ইবরানী বলা হয়। এছাড়া আরো নামকরণ আছে) বিজয় হয়। কিন্তু তারা ভাগে পায় নিম্নাঞ্চল ও টিলাভূমি। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অঞ্চলগুলো থেকে যায় কেনানীদের হাতে।
ইব্রাহিম আ. এর ইন্তেকালের ১৫০ বছর পর ইয়াকুব আ. ও তার সন্তানসন্ততি মিসরে হিজরত করেন সে বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের কারণে। তারা সেখানে জাশান বা “ল্যান্ড অব গোসেন” নামক অঞ্চলে বাস করে ৩৫০ বছর। খ্রীস্টপূর্ব আনুমানিক ১৩০০ আব্দে মুসা আ. তাদের নিয়ে সিনাই উপত্যকায় হিজরত করেন ফেরাউনের নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য। এরপর তীহে ময়দানে তাদের কেটে যায় চল্লিশ বছর। একপর্যায়ে ইউশা বিন নুন জর্ডান নদী পার হয়ে কেনানের অভ্যন্তরীণ ভূমি জয় করেন। খ্রীস্টপূর্ব আনুমানিক ১০০০ আব্দে ইসরায়েল রাজ্যে গঠন করেন। জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু সুলাইমান আ. এর মৃত্যুর পর তা দু-ভাগে বিভক্ত হয়। উত্তরে ইহুদা সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণে সামেরা কেন্দ্রিক ইসরায়েল সাম্রাজ্য। তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলতেই থাকে। খ্রীস্টপূর্ব ৭২১ আব্দে সম্রাট সারজুন আশূরী ইসরায়েল সাম্রাজ্য ধ্বংস ধ্বংস করে। খ্রীস্টপূর্ব ৫৮৬ আব্দে নবুখতেনছর ইহুদা সাম্রাজ্য ধ্বংস করে।
- ইহুদিদের ডায়াসপোরিক জীবন
লেখক ইহুদিদের ডায়াসপোরার আলোচনা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সুস্পষ্ট করেন যে, কোন কোন ডায়াসপোরায় কোন কোন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ইহুদিরা তিন থেকে চারটি ডায়াসপোরার সম্মুখীন হয়।
প্রথম : বাবেলীয় ডায়াসপোরা
সারজুন আশূরী সামেরাতে বসবাসকারী ইহুদিদের বাবেলে নিয়ে যায়। এরপর নবুখতেনছর ইয়াহুদা সাম্রাজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে অধিকাংশ ইহুদিকে বাবেলে নিয়ে। এর অর্ধশতক পর পারস্যের কর্তৃত্বকালে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়। তখন মার খেয়ে অবশিষ্ট পঞ্চাশ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে ফিরে যায়। আর যে-সব ইহুদি বাকি ছিল তাদের কিছু ইরাকে অবশিষ্ট ছিল। অন্যান্য ইহুদিরা পারস্য, আফগান, বুখারা সমরকন্দ, ককেশাস, ভারত ও চীনে অবস্থান করে।
আরবে বসবাসকারী ইহুদিদের ব্যাপারে লেখক দৃঢ়ভাবে কিছু বলতে পারেন নি যে, তারা কি বাবেলীয় ডায়াসপোরার মাধ্যমেই আরবে এসেছে। তবে যথাসম্ভব হতে পারে যে তারা কনভার্ট ইহুদি। তদ্রূপ ইয়েমেনের ইহুদিদের ব্যাপারে একই সম্ভাবনা।
দ্বিতীয় : হেলেনিক ডায়াসপোরা
এ ডায়াসপোরা শুরু হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ধারা মাধ্যমে, যা পারস্য শাসনের আরো দু’শতক পর। তার ধারা অব্যাহত থাকে সেলিউসিড, বাতালেমা, ও বাইজেন্টাইনদের যুগেও। এর সূত্র ধরে তারা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আলেকজেন্দ্রিয়ার তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ ছিল। মিসর ছাড়া তাদের আরো দু’টি প্রধান কেন্দ্র ছিল : বলকান ও কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চল। বলকান অঞ্চল ধরে ইহুদিরা রাশিয়ায় অনুপ্রবেশ করে।
এ সব অঞ্চলে বসবাসকারী তাতারদের খাজারীয় জনগোষ্ঠী ইহুদি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম দশকে তাদের বিশাল ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। এভাবে এ অঞ্চল কনভার্ট ইহুদিদের মাধ্যমে ভরপুর হয়ে।
তৃতীয় : রোমানিক ডায়াসপোরা
খ্রিস্টীয় ৭০ সালের হত্যাকাণ্ডে রোমানরা ইহুদিদের কচুকাটা করে এবং জেরুজালেম দখল। ১৩৫ সালে তারা মুকাবী বিদ্রোহী করে, তাদের রোমানরা চূড়ান্তভাবে হত্যা করে। তখন থেকে ইহুদিদের সাথে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়।
রোমানদের এ হত্যাকাণ্ডে মুক্তি পায় মাত্র চল্লিশ হাজার ইহুদি। রোমান প্রশাসন তাদের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে তাদের সংখ্যা চার থেকে সাত মিলিয়ন! মানে এ কয়েক শতকে ১০০ থেকে ১৮০ বার তাদর প্রজন্মান্তর হয়েছে। এটা অসম্ভব। বরং তাদের এ জনবৃদ্ধির কারণ হতে পারে জাতিগত সংমিশ্রণ এবং ধর্মান্তর।
চতুর্থ : আধুনিক ডায়াসপোরা
পঞ্চদশ শতক থেকে আমেরিকা আবিস্কার হওয়ার থেকে তাদের অভিবাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে আমেরিকা। তাদের বিশাল সংখ্যা এখন সেখানে। নাৎসিদের নির্যাতনের পর কিছু ইহুদি আমেরিকা গমন করে। এবং ফিলিস্তিন জবরদখলের তারা ফিলিস্তিনে এসে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করে।
প্রথম পর্ব এখানেই শেষ। বাকি পর্বে অন্যান্য আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।