জায়নবাদের অপর নাম সহিংসতাবাদ না সহিংসতাবাদের অপর নাম জায়নবাদ; কি শিরোনাম দিবো এ নিয়ে দীর্ঘ সময় চরকির ঘূর্ণিতে ন্যায় ছিলাম। শেষে নির্দিষ্ট নির্ধারনী ছাড়াই একটা দিয়ে দিলাম। কারণ সহিংসতার গুন (?) তাদের মাঝে এতটাই মিশেছে যে, শরবত থেকে চিনির পৃথকীকরণ যেরূপ অসম্ভব, সহিংসতাকে জায়নবাদের কাছ পৃথক করা আরো বেশি অসম্ভব। “অতি” যোগ করে “অতিসহিংসতাবাদ” বলাটা শ্রুতিমধুর হলে তাই বলতাম। বরং তাদের সহিংসতার সঠিক প্রতিকৃতি বুঝানোর ক্ষেত্রে “সহিংসতা” বা “অতিসহিংতা” উভয় শব্দই অকার্যকরী। তারা এ গুণে এতই মহমান্বিত (?) যে, অবিধানে এ প্রথম শব্দ-ভাটা পড়ল। আমি কিছুই অত্যুক্তি বলছিনা। বিশ্বাস না হলে তাদের প্রোটোকলগুলোতেই দৃষ্টিপাত করুন।
হ্যাঁ পাঠকমণ্ডলী, আজ আপনাদের সামনে সেরূপ এক গ্রন্থ নিয়ে হাজির হয়েছি যাতে জায়নবাদের সহিংসতার প্রতিকৃতি ফুটে ওঠে। বইয়ের মূল নাম : الصهيونية و العنف । শিরোনামে যা দেয়া হয়েছে, তাই বইয়ের শিরোনামের অর্থ।
• লেখক পরিচিতি
লেখক আব্দুল ওয়াহহাব মাসীরী। এখানে এ সীমিত পরিসরে তাঁর পরিচয় সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতেও পোস্টের পরিসর দীর্ঘতর হবে। বই সম্পর্কে আর জানা হবেনা। তারপরও কিছু বলে নেওয়া ভাল। নাম তো জানলেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রাথমিক তথ্যটাও জেনে নেই।
জন্ম ১৯৩৮ সালে, মিসরের “দিমানহোরে”। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাদীক্ষা। ১৯৫৫ তে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ হলে শিক্ষকতার পদে সেখানেই নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে আমেরিকা যান, ১৯৬৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এবং ১৯৬৯ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি নেন রাটজার ইউনিভার্সিটি থেকে।
আমেরিকা থেকে আসার পরে মিসরের “আইনে শামস” ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার দায়িত্ব নেন। তাছাড়া আরবের আরো প্রসিদ্ধ ইউনিভার্সিটি, যেমন : সৌদি আরবের কিং সউদ ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলারের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন পরিষদ, সংস্থার ঊর্ধ্বতন পদে ছিলেন। তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা সত্তরের উর্ধ্বে। এর ভেতরে জায়নবাদ ও ইহুদিদের নিয়েই তার গ্রন্থমালা বিশ ছাড়িয়েছ। তার মধ্যে অন্যতম “ইহুদি বিশ্বকোষ”। বিংশ শতাব্দীতে রচিত অনন্য বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। এছাড়াও “রিহলাতী আল-ফিকরিয়্যা” ( আমার চিন্তাবৃত্তিক সফর) নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থের কারণে নিজের অনন্যতার সাক্ষরতা দেখান। ২০০১ সালে শ্রেষ্ঠ বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য বইয়ের আলোচনা তো দূরের কথা নামোল্লেখও এ পরিসরে অত্যুক্তি হবে।
২০০৮ সালে ৩ এপ্রিল দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন। (আল্লাহ তাকে রহম করুন)
• বই পরিচিত
আরবিতে জায়নবাদের সন্ত্রাস-কর্ম ও উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করা হয় উক্ত বইয়ে। অধিকাংশ আলোচনার ভিত্তি টানা হয় আরব্য-ফিলিস্তিনে ব্যাক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মের উপর। তবে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক সূত্র এবং তথ্য প্রবাহ টেনে আনা হয়। তবে এ ইতিহাসের সহজাতবৃত্তি অথবা তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রে গোপনীয় ধারা উল্লেখ নেই। ( আস-সাহয়ুনিয়্যা ওয়াল উনফ, পৃষ্ঠা : ৫। দারুস সুরূক, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০২)
আরবের লাইব্রেরিগুলোতে জায়নবাদের এ ধরণের গবেষণা সম্বলিত বই প্রায় নেই বললেই চলে, যাতে তাদের কাঠামোগত দিকসমূহ আলোচনা করা হয় এবং তাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্ম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের পেছনে লুক্কায়িত চরিত্রের স্বরূপ করা হয়। লেখক তাদের এসব প্রতিকৃতির ক্ষেত্রে সহিংসতাকেই পান এবং সে নামেই বইয়ের নামকরণ করেন।
জায়নবাদী সহিংসতার বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতি রয়েছে। তবে যাই হোক, এটাকে তাদের গাঠনিক ভিত্তিমূলে ধরা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি ইহুদীদের জায়নবাদীদের থেকে স্বতন্ত্র চরিত্রে উল্লেখ করেন এবং তাদের ক্ষেত্রে এটাকে আপেক্ষিক মনে করেন। যদিও বর্তমান সময়ে সেমেটিক ধারার ইহুদী যাদের বংশমূল ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে সম্পৃক্ত তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বইয়ে সর্বমোট ১৪টি পরিচ্ছেদ। প্রথম দুই পরিচ্ছেদে জায়নবাদ কর্তৃক ইহুদী-নিন্দার ব্যাপারটিকে সাব্যস্ত করেন। তৃতীয় পরিচ্ছেদে নিজেদের প্রতি জায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়। চতুর্থ পরিচ্ছেদে ইহুদিদের বিরুদ্ধে জায়নবাদের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত বিবরণ।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ থেকে পরের পরিচ্ছেদসমূহে আরবের বিরুদ্ধে জায়নবাদী সহিংসতার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়। পঞ্চম পরিচ্ছেদ আরবের বিরুদ্ধে তাদের চিন্তাবৃত্তিক অবস্থান, ষষ্ঠ ও সপ্তম পরিচ্ছেদে উপনিবেশিক শক্তির ছত্রছায়ায় তাদের বেড়ে ওঠা ও দেশ-দখলের কাহিনী। পরবর্তী তিন পরিচ্ছেদে দেশ-দখলের পর থেকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, স্বায়ত্তশাসন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাংঘর্ষিক অবস্থানের বিবরণ।
শেষ পরিচ্ছেদগুলোতে জায়নবাদী বিভিন্ন সংস্থার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস আলোচনা করা হয়, যাতে তাদের সহিংস মনোবৃত্তিকে গাঠনিক ও আঙ্গিক স্থাপনার মতোই সাব্যস্ত করা হয়।
বইয়ের শেষ রয়েছে মুলহাক (অন্তর্ভূক্তি) । যাতে বিভিন্ন পরিভাষার ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া হয়। মসীরী সাহেবের বইয়ে কঠিন দিক এটাই, পরিভাষা সমূহ হল করার ক্ষেত্রে আবর পাঠকরাই জটিলতার সম্মুখীন হন। আমাদের মতো অনারবীদের ক্ষেত্রে তো জটিলকা আরো দৃঢ়তর হয়।
পরিশেষে জায়নবাদী মহল মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রাকারে যেসব ফাঁদ পেতে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্যক অবগতি থাকতে হবে। আব্দুল ওয়াহহাব মাসীরী জায়নবাদ নিয়ে আলোচনার যে ক্ষেত্রে নতুন পরিধি নির্মাণ করেন, তা আমাদের সম্যক অবগতির ক্ষেত্রে সকল ঘাটতি পূরণ করবে। তাই তাঁর বই সমূহ অনুবাদের মাধ্যমে পাঠক-চাহিদার খোরাক আমরা জোগাতে পারি।