লোকে কি বলবে

আসিফ আহমাদ


এক
বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে-‘চক্ষুলজ্জা’। এর অর্থ হচ্ছে-চোখে লজ্জাজনক ঠেকে এমন কিছু করতে বা বলতে সংকোচ বা কুন্ঠা। একটা উদাহরণ দেখা যাক, আমার ঘটনাই বলি। আমার দাদা মারা গেলেন। চাচা ফুপুরা সবাই উপস্থিত। কাফন দাফনের পর গ্রামের বাড়ি থেকে সবাই মফস্বল শহরের বর্তমান বাড়িতে আসলেন। চোখেমুখে দুঃখের ছাপ স্পষ্ট। এর মধ্যেই আলোচনা উঠল চল্লিশা নিয়ে। অর্থাৎ, দাদা মারা যাওয়া উপলক্ষে মানুষকে খাওয়াতে হবে! তাও আবার গরু জবাই করে!! আমার চাচা ফুফুরা সবাই শিক্ষিত। সম্ভবত এই কারণে মৃদু গুঞ্জন উঠল-“বাবা মারা যাওয়া কি সুখের যে ভোজসভা করতে হবে?! কিন্তু আপত্তি ধোপে টিকলো না। কারণ, লোকে কি বলবে !!?

লক্ষ্য করুন, এই চক্ষুলজ্জা কিন্তু শুধুমাত্র এজন্যই যে, এটি একটি সামাজিক প্রথা। এই প্রথা পালন না করলে সমাজের কিছু মানুষজন সমালোচনা করবে। এক্ষেত্রে কিন্তু ইসলামের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘লোকে কি বলবে’ বিষয়টিকে।
দুই
আমাদের সমাজ ইসলামি সমাজ নয়। বিভিন্ন কারণে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও চিত্র আমাদের সমাজের মানুষজন জানেনা। তাই এ কথা ভাবার কোন কারন নেই যে, যেসব বিষয়ে আমাদের সমাজে চক্ষুলজ্জা আছে তা ইসলামী নীতির কারণে। বরং এমন অনেক ‘চক্ষুলজ্জা’ আমাদের মাঝে বিদ্যমান যে ব্যাপারে লজ্জা ইসলাম সমর্থন করে না।
যেমন, ইসলাম কাজ করে উপার্জনকে লজ্জাজনক মনে করে না। বরং এতে উৎসাহ দেয়। অথচ আমাদের সমাজের অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক কাজ করতে লজ্জা পায়। কারন লোকে কি বলবে!?

আবার এমন অনেক বিষয় আছে যে সব বিষয়ে চক্ষুলজ্জা ইসলাম শুধু সমর্থনই করেনা বরং বিষয়টি ইসলামে কাম্য। যেমন প্রাপ্তবয়স্কদের হাফ প্যান্ট পড়ে থাকা। এব্যাপারে চক্ষুলজ্জা ইসলামে কাম্য।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি যে, সমাজে প্রচলিত চক্ষুলজ্জার বিষয়গুলো ঢালাওভাবে সব গ্রহণীয়ও নয় আবার বর্জনীয়ও নয়। বরং এক্ষেত্রে আমাদের একটি মানদণ্ড চাই। আর মুসলিম হিসেবে আমাদের নিকট সেই মানদন্ড হচ্ছে ইসলাম।

তিন
ইংরেজি taboo (ট্যাবু) শব্দের অর্থ হচ্ছে-‘কোন কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্ম বা লোকাচারে অনুচ্চার্য, অস্পৃশ্ব বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয় এমন কিছু। [Bangla academy English Bangla dictionary,750]
বর্তমানে কিছু ভাই বিভিন্ন বিষয়ে জোরেশোরে প্রচার করছেন যে, এসব বিষয়ে ট্যাবু ভাঙতে হবে। সোজা কথায়, ‘লোকে কি বলবে’ এই ভয়ে যেসব কাজে আমাদের সমাজ বাধা দিয়েছে, সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে সেসব এখন করতে হবে। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর বিকল্প নাই ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইতোপূর্বে আমরা চক্ষুলজ্জা নিয়ে আলোচনা করেছি। আর আমরা বলেছি যে, ঢালাওভাবে সব চক্ষুলজ্জা গ্রহণীয়ও নয় বর্জনীয়ও নয়। ট্যাবু ভাঙার ব্যাপারেও আমাদের একই কথা। কারণ, ট্যাবুর অর্থ আমরা দেখেছি-লোকাচার বা নির্দিষ্ট ধর্মের কারণে অনুচ্চার্য বা নিষিদ্ধ।
তাই এক্ষেত্রে, বিষয়টা যদি শুধুমাত্র লোকাচার হয় তাহলে আমরাও এটি ভাঙ্গার পক্ষে। যেমন আমাদের সমাজে পর্ণগ্রাফির বিরুদ্ধে কথা বলা একটা ট্যাবু। অথচ সমাজকে সুস্থ রাখতে হলে এ ব্যাপারে কথা বলতেই হবে। তবে অবশ্যই শালীনতা বজায় রেখে।
কিন্তু সেই ট্যাবুটা যদি ধর্মের কারণে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইসলামের কারনে নিষিদ্ধ হয়, তাহলে একজন মুসলিম হিসেবে এই ট্যাবু ভাঙ্গা তো দূরের কথা, আমরা সেকথা চিন্তাও করতে পারিনা। বরং এক্ষেত্রে আমরা তাই বলব যা বলেছিলেন আমাদের দ্বিতীয় খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-رضيت بالله ربا و بالاسلام دينا وبمحمد نبيا ورسولا
আল্লাহকে রব হিসেবে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী ও রাসূল হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট।

পরিশেষে বলি, বর্তমানে ইয়াং জেনারেশানকে ট্যাবু ভাঙ্গার আবেগি স্লোগান শুনিয়ে ইসলামের বিধি-নিষেধ এর প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলা হচ্ছে। আর ইয়াং জেনারেশানও ইসলামকে সঠিকভাবে না-জানা ও না-বোঝার কারণে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে।
আমরা বলব, ইসলামকে না-পড়া ও না-জানাই এর কারণ। ইসলামকে না জানার কারণে হয়তো তারা নিজের অজান্তেই ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন।
তাই, ট্যাবু ভাঙ্গার আহ্বান শুনলেই আবেগে গদগদ না হয়ে দেখতে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হে ইয়া নেহি !?
নতুবা যাচাই-বাছাই ছাড়া সব ট্যাবু যদি ভাঙ্গা শুরু হয়, তাহলে আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।

Leave a Reply