১৯৪৮ সালে জায়নবাদের মাধ্যমে আরব বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রে ইজরায়েল রাষ্ট্রের সূচনা হয়। এ দুর্যোগময় পরিস্থিতিকে “নাকবাহ ৪৮” নামে অভিহিত করা হয়। পরে ১৯৬৮ সালে মাত্র কয়েকঘন্টা যুদ্ধের ব্যবধানে ইজরায়েলের কাছে সকল আরব বাহিনী পরাজিত হয়, তাকে অভিহিত করা হয়” নাকসা ৬৭”। “নাকবাহ” দুর্যোগ-দুর্দৈব, অবনতি ইত্যাদি অর্থে প্রয়োগ হয়। আর “নাকসা” শব্দের প্রয়োগ হয় যখন এসবের দ্বিরুক্তি ঘটে । তাহলে আমরা অভিহিতার্থের ক্ষেত্রে সাযুজ্য দেখতে পাই যে, ৪৮তে আরবদের মাঝে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আরবের জন্য অবনতি ছিলো। কিন্তু ৬৭’র পরাজয়ের মাধ্যমে তাদের পুনরবনতি হয়। যদি আমরা বিচক্ষণ দৃষ্টিতে দেখি, তাদের এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপে সূক্ষ্মতা ও ধারাবাহিক পরিসর দেখি। বলতে হয়, আঠারো শতকের ত্রিশ ও আশি দশকে যথাক্রমে আলজেরিয়া ও মিসরে সাম্রাজ্যবিস্তার এ পরিকল্পনা-ধারারই প্রাক্তন কর্ম ছিলো।
তাদের এসব পরিকল্পনার ছুতোয় গ্রন্থিযুক্ত হয় প্রাচ্যে প্রেরিত বিভিন্ন মিশনারী কার্যক্রম। বৈরুত, কায়রো, ইস্তাম্বুল সহ আরো বিভিন্ন স্থানে তাদের কার্যক্রম গতিমুখ পায়। প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানরা তো বুঝতেই পারেনি তাদের ধারাবাহিক কার্যক্রমের মতিগতি কি। তাই সে কর্মধারাকে কোন শিরোনামে অবিহিত করবে, তা জানা ছিলোনা। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ভাষায় এর নাম পড়ে “ওয়েষ্টারনাইযেশন”। ১৯৩০ সালে হ্যামিল্টন জেব “ভোকেশন অফ ইসলাম” গ্রন্থে এ কার্যতৎপরতার সম্যক আলোচনা করেন।
এ পরিকল্পনার ছুতোধারায় যুক্ত হয় ১৮৯২ সালে প্রণয়নকৃত the protocols of the elders of zion, তদ্রূপ ব্রিটিশ মন্ত্রী ক্যাম্বেলের প্রতিবেদন, যাতে এশিয়া-আফ্রিকার পৃথককরণের মাধ্যমে আরব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভক্তি কথা বলা হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন সভাসমাবেশ ও কর্মধারা, যার নথিপত্র এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উদঘাটন হয়। এসবের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি জায়নবাদ কিভাবে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে মিলে উসমানী খেলাফত ধ্বংসের মাধ্যমে ফিলিস্তিন জবরদখলের পথ তৈরি করে। আরবত্ব ও ইসলামের মাঝে ফাটল ধরিয়ে একতা বিনষ্ট করে।
এসব কর্মকাণ্ডের অভিলক্ষ্য ছিলো কুদসের কর্তৃত্ব থেকে মুসলমানদের সরিয়ে পাশ্চাত্য-শক্তির বিস্তার। এ প্রচেষ্টাই আটশো বছর আগে ছিল ফিরিঙ্গিদের । এখন সে প্রচেষ্টায় মাঠে নামে জায়নবাদের। ১৯১৮ সালে এডমন্ড অ্যালেনবি যখন কুদসে প্রবেশ করে, এ ঘোষণা দেয় : ‘এখন ক্রুসেড যুদ্ধ শেষ হল’। বাস্তবে এসবই ছিল কুদসের উপর জায়নবাদের কর্তৃত্বের আগাম পূর্বাভাস ছিল। বিভিন্ন সূত্র এটাই সাব্যস্ত হয় যে, পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জায়নবাদের নখর-থাবাই ছিল।
সাম্রাজ্যবাদ, জায়নবাদসহ পাশ্চাত্যের সামগ্রিক শক্তির এক উদ্দেশ্য। ইসলামি চিন্তাবৃত্তিকে পশ্চিমায়ন করা, বিভিন্ন অভিযোগ আরোপ ও সন্দেহ উত্থাপনের মাধ্যমে ইসলামি ব্যাক্তিত্ববোধ বিনষ্ট করা। সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহকে গলাধঃকরণ ও বিশ্ব কর্তৃত্বের গলনপাত্রে দ্রবীকরণ। যার মূলে রয়েছে তালমূদীয় ইহুদিগোষ্ঠি। পাশ্চাত্যের খ্রিষ্ট চিন্তাবৃত্তিতে নিজেদের পূর্ণ প্রভাব প্রতিফলনের পর ইসলামি চিন্তাবৃত্তিই তাদের অভিলক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে।
সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, পশ্চিমায়ন ও পরভাববাদের অবিচ্ছিন্ন আন্দোলন-ধারায় এখন পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার উন্মোচন ঘটে। নিকটবর্তী সময়ে সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট এক গবেষণায় ইব্রাহিম (আ.) এর ব্যাক্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি করা হয়। যদিও আসমানি ধর্মগ্রন্থ বিশেষভাবে কোরআনে তাঁর নামের উল্লেখ আছে। “নাকসা ৬৭” পর্যন্ত তাদের এসব অপপ্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
“নাকসা” পরে পশ্চিমায়ন আন্দোলনের মৌলিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ পায়। আরবদের ধর্মনিরপেক্ষ করা, ধর্মীয় গণ্ডী থেকে বের করে নতুন প্রজন্ম তৈরির প্রাণপণ চেষ্টায় লেগে পড়ে।
আরবের সর্বক্ষেত্রে এ মতবাদের প্রচার হতে থাকে। পশ্চিমায়নবাদীরা তাদের এ বোধগম্য করার চেষ্টা করে যে, এটাই আরবদর সকল সংকট, অবনতি ও পুনরবনতি হাত থেকে রক্ষা করবে।
অথচ বাস্তবতা তাদের এ দাবির খণ্ডন করে। ঘটনাপ্রবাহে তাদের এ কাল্পনিক চাওয়া-পাওয়ার অসারতা সাব্যস্ত হয়। ইতিহাস থেকে আমরা এটাই জানতে পারি যে, আরবজাতি নিজেদের মৌলিকত্বের পথ আবিষ্কার করে এবং সে মৌলিকত্বে অবশিষ্ট থাকে ধর্মকে জীবনবৃত্তির ঘনিষ্ঠ সহচর বানিয়ে, পরভাববাদ ও বিজাতীয় সংস্কৃতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র জীবনবৃত্তির মাধ্যমে। ইতিহাসের পাতায় আরবের যথাযোগ্য অবস্থান হয় তাদের ইসলামি জীবনবৃত্তির শতভাগ অনুসরণ-অনুকরণে। ইতিহাস এ বার্তাই দেয় আমাদের।
“নাকসা ৬৭”র পর পশ্চিমায়নবাদী কর্মধারার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। বলতে থাকে : আরবরা হয়তো নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ-রক্ষাকে বেছে নিবে, তার পরিবর্তে জায়নবাদের জবরদখলের স্বীকার হবে; নতুবা আরবত্ববোধের বিসর্জন দিয়ে জায়নবাদের অপশৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্তি দেবে। তাদের এ হাস্যকথার তো এমনিতেই উড়ে যায় যে, নিজেদের মূল্যবোধ বিসর্জন কি নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষার মাধ্যমে হবে?
তাদের চেষ্টা-প্রেচষ্টা ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিবর্তন ধারানো, তার সহজাতবৃত্তি ও কর্মোদ্দীপনার অস্বীকার। এখন প্রশ্ন হল, ১৪০০ বছরের দীর্ঘ পরিসরে মূল্যবোধ ও কর্মোদ্দীপনার মাধ্যমে যে বুদ্ধিবৃত্তির বিনির্মান, তা কোন পর্যায় অতিক্রম ব্যতীত মূল গতিধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে বা তার কর্মধারা থেমে যাবে?
একত্ববাদ এ বুদ্ধিবৃত্তির মূলভিত্তি। আখেরাত-বিশ্বাস যার বর্নিল প্রতিকৃতি দাঁড় করিয়েছে। কোরানী চেতনায় দীপ্ত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসায় লেগেছে। ফলে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাত্ত্বিক মতবাদের উৎসারণ করেছে। উন্নতি-অগ্রগতি, সামাজিক ন্যায়নীতি ও শূরাভিত্তিক কর্ম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সভ্যতার যথার্থ প্রতিকৃতি দেখায় মানবতাকে।
এ বুদ্ধিবৃত্তি তাঁর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আলোকিত করেছে এ পৃথিবী। বর্তমানের পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎকর্ষ-মূল মুসলমানদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও আইনশাস্ত্র। পৌত্তলিকতার বিনাশ করে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের চিন্তাবৃত্তিতে শোধবোধ তৈরি করে। দেয় নবচিন্তার ধারা। মুক্ত করে গোলযোগ-বিশৃঙ্খলা থেকে। উন্মুক্ত করেছে স্বাধীন চিন্তাবৃত্তি ও স্রষ্টার সাথে মধ্যমহীন সম্পর্ক স্থাপনের পথ। মানুষ ও তার সহজাতবৃত্তির মাঝে তৈরি করে সাযুজ্যতা ও নিকটবর্তী অবস্থান।
এইসবের পরও কি এ বুদ্ধিবৃত্তি পরভাববাদের আশ্রিত হবে? বিনাশ-বিলোপের পথ ধরবে? তারা মনে করেছে এটা কোন মানবীয় চিন্তাবৃত্তির পরিসর অথবা কোন দার্শনিক মতবাদ; ফলে সেসবের মতোই তাকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা সম্পূর্ণ বিলোপ করা যাবে। বরং তালমূদীয় ইহুদিশক্তি যখন পশ্চিমা চিন্তাবৃত্তিকে গ্রাস করে, এরূপটাই হয় তাদের ক্ষেত্রে। প্রোটোকলের ধারাপাত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে নেয়, আদর্শহীন করে।
মুসলমানদের রয়েছে চিন্তাবৃত্তিক উৎকর্ষ, জীবনবৃত্তিক দর্শন। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নীতিশাস্ত্র ও প্রতিপালনবিদ্যায় বিভিন্ন মূলনীতি। বর্তমানে যদিও পাশ্চাত্যের ঠুনকো দর্শনে তাতে আলতো প্রলেপ পড়ে, তবে তা মৌলিকত্বের স্বকীয়তা নিয়ে এখনও অবশিষ্ট।
পাশ্চাত্য-চিন্তাবৃত্তি প্রথমে ধর্মতাত্ত্বিক ছিল, পরে দার্শনিক। শেষ পরিসরে তা হয় বৈজ্ঞানিক। কিন্তু ইসলামি চিন্তাবৃত্তি শুরু থেকেই কোরানী আদর্শের ধারামতে চলে, যা যুক্তি ও হৃদয়, বস্তু ও আত্মার সমন্বয়। তাতে নেই প্রান্তিকতা তথা শুধু বস্তুবাদ বা শুধু আধ্যাত্মবাদ।
লরেন্স ব্রাউন বলেন : ‘আমাদের মূল সমস্যা লুক্কায়িত ইসলামের নিয়মাবলির ক্ষেত্রে। কেননা তাতে একদিকে থেকে রয়েছে ছাড় অন্যদিকে রয়েছে অনুশাসন। যা জীবনবৃত্তির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রাখে। আর এটাই আমাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে’।
জার্মানীয় চিকিৎসক ফ্রানজ মেসমার বলেন : পশ্চিমারা ধর্মত্যাগের বদৌলতে জ্ঞানী হয়, আর মুসলমানরা মূর্খ হলেই ধর্মত্যাগ করে।
একারণে পাশ্চাত্যের ভয় সদাসর্বদা যে, মুসলমানরা কখন ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়।
সুতরাং আমাদের কি এখনও প্রয়োজনবোধ হয়নি মানসপট নির্ধারণের, যার বৃত্তে ইসলামি চিন্তাবৃত্তি ঘুরপাক খাবে। হ্যাঁ… সে মানসপট আছে কোরআনে; আছে সে সহজাতবৃত্তিতে, যার অনুপম ধারা রয়েছে ইসলামে। এধারা সুপ্ত মুসলমানদের অন্তঃকরণে, যদিও পশ্চিমায়ন-ধারা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তা থেকে মুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টায় মগ্ন। সুতরাং বর্তমানে আমাদের চিন্তাবৃত্তিক একত্ব সকল অপশক্তির মোকাবিলার শক্তি-সাহস যোগাবে। কেননা ইসলাম তার মৌলিকত্বে, স্বাভাবিকতায়, সহজতায় ও সহিষ্ণুতায় মুসলিম-মানসপটে পরিবর্তন-ধারা প্রবাহ করতে পারে। বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত করতে পারে।
পরিশেষে বলবো,পূর্বের মুসলমানরা পরভাববাদ ও অন্ধানুসরণের সকল পর্যায় অতিক্রম করেই নিজ মৌলিকত্বের পতাকাবাহী হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সফলতায় পৌছেছে। তাই সে মৌলিকত্ব-ধারায় বর্তমান প্রজন্মের পুনর্গঠন করতে হবে। ফলে তাদের মতাদর্শ, ব্যক্তিত্ব, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অন্যকোন মতাদর্শের সামনে পরাজিত হবে না। ইসলামের চেতনা নিয়ে সমুন্নত থাকবে সবসময়।
মাশাআল্লাহ ভাই, এগিয়ে যান।