নবীজির বহুবিবাহ

(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

অনুবাদ: মাওলানা আসআদ হাসান বিন মাহমুদ

ইসলাম ধর্ম আসার পূর্বে অধিকাংশ ধর্মে একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা বৈধ ছিল।তখন আরব,ভারত বর্ষ,ইরান,মিশর,গ্রিস,বেবিলন, ইত্যাদি দেশে প্রত্যেক জাতির মাঝে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার প্রথা ছিল। বর্তমানেও মানুষের স্বভাবজাত এই জৈবিক চাহিদার প্রয়োজনকে কেউ অস্বীকার করে না। ইউরোপিয়ানরা তাদের পূর্ববর্তীদের বিরোধিতা করে একক স্ত্রী গ্রহণের ব্যর্থ চেষ্টা করে। অবশেষে মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পায় এবং তা বর্তমান সমাজে বাস্তবায়ন করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মাস্টার ডিভন পোর্ট “যিনি একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী”, তিনি ইঞ্জিলের বক্তব্য উদ্ধৃতির পর উল্লেখ করেন “একাধিক স্ত্রী গ্রহণ শুধু উত্তম নয়, বরং আল্লাহ এতে বিশেষ বরকত রেখেছেন”।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হল-, ইসলাম আসার পূর্বে একাধিক স্ত্রী গ্রহণে কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না.। একজন ব্যক্তির অধীনে কয়েক হাজার স্ত্রী থাকতো। খ্রিস্টান পাদ্রীগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত ছিল। 16 শো খ্রিস্টাব্দে জার্মানে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ছিল একটি বহুল প্রচলিত প্রথা।
সারসংক্ষেপ কথা হল, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ধর্মের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, কোন ধর্মে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের কোন সংখ্যা নির্ধারণ ছিলনা। ইসলামের শুরুলগ্নেও এই প্রথা চালু ছিল, অর্থাৎ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা অনির্ধারিত ছিল। কিছু কিছু সাহাবায়ে কেরামের চারের অধিক স্ত্রী ছিল। এমনকি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার ইন্তেকালের পর ইসলামের প্রয়োজনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীর সংখ্যা 10 পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
পরবর্তীতে দেখা গেল যে,একাধিক স্ত্রী গ্রহণ এর ফলে মহিলাগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অতঃপর রাব্বি কারীমের পক্ষ থেকে শাশ্বত আইন অবতীর্ণ হল। মানুষের জৈবিক চাহিদাকে সামনে রেখে রাব্বে কারীম শর্তসাপেক্ষে একজন পুরুষের অধীনে চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছেন। যদি শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে একজন পুরুষের অধীনে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা অন্যায়।
উপরোক্ত বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর সকলের ঐক্যমতে একজনের নিকট চারের অধিক স্ত্রী রাখা হারাম হয়ে যায়। যেসকল সাহাবার নিকট চারের অধিক স্ত্রী ছিল তারা চারজন স্ত্রী কে বাছাই করে বাকীদেরকে তালাক দিয়ে দেন।
যেমন,হাদীসে এসেছে–হযরত গায়লান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার স্ত্রী সংখ্যা ছিল 10। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন তুমি চারজন রেখে বাকীদেরকে তালাক দিয়ে দাও। অনুরূপ হযরত নওফেল ইবনে মুয়াবিয়া রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর অধীনে 5 জন স্ত্রী ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মধ্য থেকে একজনকে তালাক দেওয়ার জন্য আদেশ দিলেন।
———–
নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)বহুবিবাহ’
——————–

প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যাপক আইনের আওতায় নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণও কি অন্তর্ভূক্ত?
উত্তর হচ্ছে- না। কারণ রাব্বুল আলামীন প্রিয় নবীজির সহধর্মিণীদের অন্যান্য মহিলাদের থেকে ভিন্ন বলে উল্লেখ করেছেন।রাব্বুল আলামীন বলেন–“يا نساء النبي لستن كاحد من النساء”
অর্থাৎ, “হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য কোন মহিলার মত নও”।
তাঁরা হলেন উম্মাহাতুল মুমিনীন। তাছাড়া নবীজির পরে তাঁরা বিয়ে করতে পারবেন না। তাদেরকে যদি ব্যাপক আইনের আওতাভুক্ত করা হয় সেটা তাদের প্রতি হবে নিতান্ত অন্যায়। কেননা নবীজির সঙ্গত্যাগ তাদের জন্য নির্মম বেদনাদায়ক। অপরদিকে অন্যের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিলে বিষয়টি তাদের জন্য কতই না কষ্টদায়ক হতো। একেতো রাসুলের সঙ্গত্যাগ, দ্বিতীয়তঃ নতুন সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার বেদনা.। বিশেষ করে তাঁদের জন্য যাদের নবীজি বিয়ে করেছেন তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য। কারণ তাঁদের স্বামী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন এবং তারা হয়েছেন নিঃস্ব। এরপর যদি তাদেরকে তালাক দেয়া হতো তাহলে তাদের বুকে কি ঝড় বয়ে যেতো তা অনুমান করাও কঠিন! তাছাড়া পরিচয় সূত্রে নবীজির স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করে সারা জীবন বিবাহ থেকে মাহরুম থাকা উত্তম নয় কি?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিঃস্ব জীবন কে সর্বস্ব করার জন্য বিবাহ করেছেন এটা অনেক কারণসমূহের একটি কারণ মাত্র। সবদিক বিবেচনায় নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণ এ ব্যাপক আইনের আওতায় পড়া যুক্তিযুক্ত নয়।


আল্লাহর আদেশ
~~
আল্লাহর আদেশে একমাত্র নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারের অধিক স্ত্রী রাখার বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন। আরো লক্ষণীয় হলো’- উম্মাহর দুনিয়া ও আখেরাতের পুর্ণ সফলতার জন্য নবীজির ঘরোয়া বা পারিবারিক বিষয়গুলো জানা আবশ্যক। আর তা সম্ভবপর হবে একমাত্র নবীজির পবিত্র সহধর্মীনিদের মাধ্যমে। আর এটি এমন এক বিষয়,যেখানে নয়জন স্ত্রীীী স্ত্রীও অপ্রতুল।
এ সকল দিক বিবেচনা করে কোন মানুষ কি বলতে পারবে (নাউজুবিল্লাহ) যে, যৌনক্ষুধা মেটাতে এ বৈশিষ্ট্য অর্জন?
————————

নবীজীর প্রতি তৎকালীন মক্কার কুফফারদের এ বিষয়ে আচরণ


যখন পুরা আরব ও আজম নবীজির বিরোধিতায় লিপ্ত, হত্যার নেশায় মত্ত, মিথ্যা অপবাদ ও দোষ ত্রুটি ঘাটাঘাটিতে ব্যস্ত, এমনকি (আল্লাহ ক্ষমা করুন) পাগল, মিথ্যুক বলতো দ্বিধাবোধ করেনি.। শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক চেষ্টা করে রৌশনদার রাসূলের উপর কালিমা লেপন করতে না পেরে নিজেরাই ধ্বংস হলো। এতকিছুর পরেও কাফেররা কিন্তু নবীজির উপর নারী কেলেঙ্কারি বিষয়ক কোন অভিযোগ তুলেনি। এখানে নবীজির উপর অভিযোগ উঠানোর কোন অবকাশই নেই।নতুবা নবীজির চরিত্রের উপর আঙ্গুল উঠানোর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবে তারা এত নির্বোধও ছিল না যে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বিলীন করে দিবে। কেননা নবীজির জীবদ্দশায় কুফফারগণ নবীজির পবিত্র জীবনকে স্বচক্ষে দেখেছেন। দেখেছেন নবীজির চারিত্রিক গুণাবলী, শৈশব। , কৈশোর, বাল্যকাল, যৌবনকাল। তারা দেখেছেন নবীজির ভরা যৌবন কিভাবে কাটিয়েছেন। তিনি তার যৌবনকাল কাটিয়েছেন নিরবে নিভৃতে নির্জন গুহায় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থেকে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন 25 বছরে উপনীত হন তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসে, যিনি ছিলেন বিধবা ও কয়েক সন্তানের জননী এবং 40 বছরের বয়স্ক মহিলা। যিনি ইতিপূর্বে দুই সংসার অতিবাহিত করেছেন।সেই 2সংসারে ছিল দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার প্রস্তাব গ্রহণ—–
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার সংস্পর্শে। নবীজির সকল সন্তান একমাত্র খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার ঔরসেই জন্মলাভ করে।
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার ইন্তেকালের পর নবীজির বয়স যখন পঞ্চাশ পেরিয়ে, তখন পরবর্তী স্ত্রীগণ নবীজির সংসারে আগমন করেন। তা ছিল শরীয়তের বিশেষ প্রয়োজনে এবং তাহাদের সংখ্যা 10 পর্যন্ত পৌঁছায়। যাদের মধ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ব্যতীত সকলেই ছিলেন বিধবা এবং কয়েকজন ছিলেন সন্তানের জননী।
এ সকল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, কোন বিবেকবান মানুষ (আল্লাহ ক্ষমা করুন) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চোখ বুজে থাকা কোন ব্যক্তি যদি নবীজির আজমত, শান,বড়ত্বকে দেখতে না পায় এবং নবীজির আখলাক, আ’মাল, তাকওয়া, ত্বহারাত, সাধনা, পবিত্র জীবনের পূর্বাপর অবস্থা থেকেও কেউ যদি চোখ বন্ধ রাখে তবুও উল্লেখিত ঘটনা ও অবস্থা থেকে নিঃসন্দেহ ভাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নবীজির একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কোন জৈবিক চাহিদা মিটানোর উদ্দেশ্যে ছিল না। তাই যদি উদ্দেশ্য হত তাহলে জীবনের 55 টা বছর এক পড়ন্ত যৌবন মহিলার সাথে কাটিয়ে দেওয়া কোন মানুষের বোধগম্য নয়।
বিশেষ করে যখন কুফফারে আরব ও কুরাইশদের সরদারগণ নবীজির এক ইশারায় নিজেদের ঐশ্বর্য মন্ডিত সৌন্দর্য, রূপ লাবণ্য নবীজির কদমে উৎসর্গ করে দিতে সদা প্রস্তুত ছিল। যার সত্যতা ইতিহাসের গ্রহণযোগ্য কিতাব থেকে পাওয়া যায়।
তাছাড়াও তৎকালীন সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা লাখের উপরে হবে, যাদের মেয়েরা নবীজির সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া কে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করত।


এতকিছুর পরও প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জীবনের সঙ্গিনী হিসেবে 50 টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন একমাত্র প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার সাথে। তাও আবার খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ছিলেন 40 বছরের বয়স্ক মহিলা।
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ইন্তেকালের পর যেসকল রমণীগণ নবীজির এসেছেন একজন ব্যতীত সকলেই ছিলেন বিধবা। তাদের মাঝে আবার কেউ কেউ ছিলেন কয়েক সন্তানের জননী

পরিশেষে বলি-

বর্ণিত আলোচনাগুলো বিস্তর ব্যাখ্যা সাপেক্ষ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা আলোচনা সম্ভব নয়। নতুবা নবীজির একাধিক বিবাহ ইসলামী শরীয়তের প্রয়োজনীয়তার বুনিয়াদ কতটুকু তা আলোচনা করা যেত।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এ বৈশিষ্ট্য অর্জন না করতেন তাহলে শরীয়তের অনেক বিধি-বিধান যেগুলো একমাত্র মহিলাদের সাথে সম্পৃক্ত এবং মহিলাদের মাধ্যমে পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব তা উহ্য থেকে যেত।
কত বড় নির্লজ্জতা ও বাস্তব বিমুখতা হলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু বিবাহকে নফসের চাহিদা মিটানোর জন্য বলা যায়।
যদি ধর্মান্ধ বিবেক ও বোধ শক্তিকে অন্ধ বানিয়ে দেয় তাহলে কোন কাফের এমনটি বলতে পারেনা।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 9 জন বিবি রেখে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। নবীজির ইন্তেকালের পর বিবি গনের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত জয়নাব বিনতে জাহশ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ইন্তেকাল করেন এবং সর্বশেষ হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা।
——
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক মর্ম অনুধাবন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply