(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
অনুবাদ: আসিফ আহমাদ
আল্লামা ইবনে ইসহাক তাঁর “আসসীরাতুন নববী” নামক কিতাবে লিখেছেন: “কুরাইশ গোত্রের প্রত্যেক কবিলার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একদিন কাবা প্রাঙ্গণে সূর্য ডোবার পর জমায়েত হলো। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-উতবা বিন রবিয়া, শায়বা বিন রবিয়া, আবু সুফিয়ান, নজর বিন হারেস, আবুল বুখতারি বিন হিশাম, আসওয়াদ বিন মুত্তালিব, জাময়া বিন আসওয়াদ, ওয়ালিদ বিন মুগীরা, আবু জাহাল বিন হিশাম, আব্দুল্লাহ বিন আবি উমাইয়া, আস বিন ওয়ায়েল, উমাইয়া বিন খালাফ।“
তারা নবীজির সাথে আলোচনা করার জন্য একজনকে পাঠালো যে, কুরাইশের সম্ভ্রান্ত লোকজন আপনার সাথে আলোচনা করার জন্য উপস্থিত। আপনি তাশরিফ আনুন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু কুরাইশের সম্ভ্রান্ত লোকজনদের হেদায়েতের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন তাই তিনি অতি দ্রুত উপস্থিত হন।
তিনি বৈঠকে বসার পর কুরাইশদের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু হল। তারা নবীজীকে বলল: “হে মুহাম্মাদ! আপনি নিজ জাতির ভিতর যে বিষয়টি শুরু করেছেন আরবে ইতিপূর্বে কেউ এই বিষয়টি শুরু করেনি। আপনি নিজ জাতির ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। আপনি আমাদের পূর্বপুরুষদের গালমন্দ করেছেন। আমাদের ইলাহদেরকে দোষারোপ করেছেন। আমাদের জ্ঞানীদেরকে অজ্ঞ সাব্যস্ত করেছেন এবং গোত্রের ভিতরে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। আমরা খারাপ এমন কোন বিষয় দেখছি না যে আপনি আমাদের মাঝে আনেননি।
হে মুহাম্মদ! আপনি যেসব বিষয় আমাদের সামনে পেশ করছেন এর দ্বারা আপনার উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহলে আমাদেরকে বলুন! আমরা আপনার জন্য এত পরিমান মাল জমা করব যে, আপনি হবেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান।
আর যদি আপনার উদ্দেশ্য সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জন হয় তাহলে আমরা আপনাকে আমাদের সরদার ও বাদশা বানিয়ে নেব।
আর যদি কোন প্রেতাত্মা, জিন ইত্যাদির আছরজনিত কারণে আপনি এসব বলে থাকেন আর এর প্রতিরোধক আপনার কাছে না থাকে, তাহলে আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারি। এবং এর জন্য যত টাকা দরকার আমরা খরচ করব যাতে আপনি সুস্থতা লাভ করতে পারেন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন: “তোমরা যা বলেছ তার কোনটাই নয়। তোমরা যে সব বিষয়ে কথা বলছ তার জন্য আমি আসিনি। তোমাদের সম্পদ বা মর্যাদা অথবা ক্ষমতা কোনটাই আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে তো আল্লাহ তায়ালা রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমার উপর নাযিল করেছেন সুমহান কিতাব। আমাকে আদেশ করেছেন আমি যেন তোমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করি এবং সুসংবাদ দেই। তাই আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছাচ্ছে এবং তোমাদের কল্যাণ চাচ্ছি। আমি তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছি তা যদি তোমরা গ্রহণ করো তবে দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জগতে তোমরা সফলকাম হবে। আর যদি তোমরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করো তাহলে আমি সবর করব যতক্ষণ না আমার রব আল্লাহ আমার এবং তোমাদের মাঝে ফয়সালা না করবেন।“
এরপর কুরাইশ এর লোকেরা সভা ছেড়ে উঠে চলে গেল।তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় নিজ ঘরে ফিরে আসেন। কুরাইশরা নিজেরাই নবীজিকে ডেকে পাঠানোর কারণে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খুবই আশান্বিত ছিলেন।
এরপর মাঝে মাঝে কুরাইশরা নবীজিকে বলতো, হে মুহাম্মদ: আমরা তো আপনার উপর ঈমান আনছি না। তাই, আপনি যে আযাবের ভয় দেখান তা নিয়ে আসুন দেখি! কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তাদের উপর বদদোয়া করতেন না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, একবার কুরাইশরা নবীজি কে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আপনার রব কে বলে সাফা পাহাড় কে সোনা বানিয়ে নিতে পারেন তাহলে আমরা আপনার উপর ঈমান আনব।
নবীজী বললেন, তোমরা কি সত্যি ঈমান আনবে?
তারা বলল, হ্যাঁ।
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন। সাথে সাথে জিবরীল আলাইহিস সালাম তার কাছে আসলেন এবং বললেন, আপনার রব আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন, “আপনি যদি চান তাহলে সাফা পাহাড় কে তাদের জন্য আমি স্বর্ণে পরিনত করব। তবে এরপরেও তাদের মধ্যে যদি কেউ ঈমান না আনে তাহলে তাকে আমি এমন আযাবে নিপতিত করব যা সমগ্র জগতে আজ পর্যন্ত কাউকে করিনি।
আর যদি চান তাহলে (সাফা পাহাড় কে সোনায় পরিণত করার বদলে) তাদের জন্য আমি তওবা এবং রহমতের দরজা খুলে দিতে পারি।“
নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বললেন, “আমি তাদের জন্য তওবা ও রহমতের দরজা চাই।“ (মুসনাদে আহমদ: ২১৬৬)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কওমের জন্য সব সময় আজাবের পরিবর্তে রহমত কে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর দিবেন নাইবা কেন। তিনিতো রহমতের নবী। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে এরশাদ করেছেন: وما ارسلناك الا رحمه للعالمين অর্থাৎ,”আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি জগতসমূহের জন্য রহমত স্বরূপ”!(সূরা আম্বিয়া, ১০৭)
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি মুশরিকদের উপর কেন বদদোয়া করেন না?
নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বললেন, “আমি লানতকারীরূপে প্রেরিত হয়নি। বরং আমাকে পাঠানো হয়েছে রহমতস্বরূপ।“(মুসলিম,২৫৯৯)
এত কিছু সত্ত্বেও কুরাইশদের মন গলেনি। তারা নবীজির কল্যাণকামিতার জবাব দিয়েছে অপব্যবহার দ্বারা। নবীজিকে কষ্ট দেওয়ার কোনো চেষ্টা তারা বাদ রাখেনি। আর সাহাবায়ে কেরামকে তো চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্যাতন করেছে। শেষ পর্যন্ত নবীজীকে হত্যার চেষ্টাও করেছে।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তার পরেও কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরাইশদের মাঝে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
দীর্ঘ আট বছর পর আমার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। একদা মক্কা থেকে যিনি নিঃস্ব অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন আজ তিনি 10000 সংখ্যার বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কা আগমন করেন।
অথচ এমন দিনেও তার মাঝে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। বড় বিনয়ের কারণে তার মাথা এতটা ঝুঁকে ছিল যে, মাঝে মাঝে তা সওয়ারীর সাথে লেগে যাচ্ছিল।
এরপর তিনি কাবার দরজার সামনে দাঁড়ালেন। তার কওমের লোকেরা ভীত অবস্থায় দাঁড়ালো তার সামনে। তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমাদের কী ধারণা আজ তোমাদের সাথে আমি কেমন আচরণ করব!? তারা উত্তরে বলল, “আমরা আপনার কাছ থেকে ভালো ব্যবহারের আশা করি। আপনি তো আমাদের দয়ালু ভাই।“
নবীজী (সাঃ) বললেন, “যাও! তোমরা আজ মুক্ত।“
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মুক্ত করে দিলেন। অথচ আজ ছিল প্রতিশোধের দিন। তিনি অনায়াসেই তাদের সমস্ত জুলুমের প্রতিদান দিতে পারতেন। কিন্তু তিনিতো রাহমাতুল্লিল আলামিন। এমনকি তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতেও বাধ্য করলেন না।
কুরাইশরা যখন এমন অবস্থা দেখল তখন তারা অধিকাংশই মুসলমান হয়ে গেল।
এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা নছর নাযিল করেন: اذا جاء نصر الله والفتح ورايت الناس يدخلون في دين الله افواجا فسبح بحمد ربك واستغفره انه كان توابا
অর্থাৎ, যখন আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে এবং আপনি মানুষদেরকে দেখবেন দলে দলে দ্বীনে প্রবেশ করতে তখন আপনি আপনার রবের তাসবিহ ও ইস্তেগফারে মনোনিবেশ করুন। তিনি তওবা কবুলকারী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বিনয় সাময়িক ছিল না। বরং এটি ছিল তার সবসময়ের বৈশিষ্ট্য।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই যখন ইন্তিকাল করল, তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাই নবীজির কাছে এসে জানাজা পড়ানোর আবেদন করল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজা পড়ানোর জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলাআনহু বলেন, নবীজিকে আটকানোর জন্য আমি নবীজির সামনে দাঁড়ালাম। এবং বললাম, হে আল্লাহর নবী! আপনি কার জানাজা পড়াচ্ছেন! সে তো আল্লাহর শত্রু! অমুক অমুক দিন সে কি বলেছে আপনি কি জানেন না!
তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি হাসলেন এবং বললেনঃ হে ওমর! রাস্তা ছাড়ো! আমাকে তো ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, استغفر لهم اولا تستغفر لهم
অর্থাৎ, আপনি তাদের জন্য ইস্তেগফার করুন অথবা না করুন!
নবীজি (সাঃ) আরও বললেন, আমি যদি জানতে পারি, সত্তর বারের অধিক ইস্তেগফার করা হলে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে তবে আমি তাই করবো।
এরপর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীজির উপর চাপাচাপি করার কারণে আমি লজ্জিত হলাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর তার জানাজা পড়লেন এবং দাফনে অংশগ্রহণ করলেন। এরপর ফিরে আসলেন।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, এর কিছুক্ষণ পরেই আল্লাহ তা’আলা আয়াত অবতীর্ণ করেন:
ولا تصلي على احد منهم مات ابدا ولا تقم على قبره انهم كفروا بالله ورسوله وماتوا وهم فاسقون
অর্থাৎ, (হে নবী) তাদের (অর্থাৎ মুনাফিকদের) মধ্য হতে কেউ মারা গেলে তুমি তার (জানাযার) নামাজ পড়বে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে ও না। তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরি করেছে এবং তারা পাপীষ্ঠ অবস্থায় মারা গেছে। (তওবা: ৮৪)
ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, এরপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কোন মুনাফিকের জানাজা পড়ান নেই এবং কবরের পাশে দাঁড়াননি। (ইবনে হিব্বান: ৩১৭৬).