মাওলানা ওয়ালিউল ইসলাম
উস্তাদুল হাদিস ওয়াল ফিকহ
জামিয়া উসমানিয়া হোসাইনাবাদ, রাজশাহী।
…………………………
আরবি ভাষায় সূর্যগ্রহণকে ‘কুসুফ’ বলা হয়। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ‘কিসাফান’ ও ‘কিসফান’ শব্দ দিয়ে ‘ইনকিসাফুস শামস’ অর্থাৎ সূর্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। যাকে আমরা সূর্যগ্রহণ বলে জানি।
আজ রোববার (২১ জুন) দুপুর দেড়টার দিকে বাংলাদেশ থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদুভয়ের ওপর একটি ক্রান্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়।
সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। এর প্রমাণস্বরূপ আল্লাহতায়ালা এ দু’টোর ওপর ‘গ্রহণ’ দান করেন। আর এই দু’টি আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন বৈ অন্য কিছু নয়।
আলেমগণের মতে, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সতর্কবাণী পৌঁছে দেয় যে, অন্যান্য সৃষ্টির মতো চন্দ্র-সূর্যও আল্লাহর সৃষ্টি; এরা উপাসনার যোগ্য নয়। চন্দ্র-সূর্যইতো বিপদাক্রান্ত হয়, তাই এগুলো উপাস্য হতে পারে না। বরং এ দু’টিকে আল্লাহতায়ালাকে চেনার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাই হলো- বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে,
وَمِنْ آياتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ《》
‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, আর চন্দ্রকেও না; আল্লাহকে সিজদা করো, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু তাঁরই ইবাদত করে থাকো।’ -সূরা হা-মিম সিজদা: ৩৭
অন্ধকার যুগে মানুষের ধারণা ছিল, কোনো মহাপুরুষের জন্ম-মৃত্যু বা দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির বার্তা দিতে সূর্য বা চন্দ্রগহণ হয়। ইসলাম এটাকে একটি ভ্রান্ত ধারণা আখ্যায়িত করেছে। গ্রহণকে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল বা বিপদের সময় গণ্য করেছে।
সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের সময় মুমিনদের কর্তব্য হলো, অন্যান্য কাজকর্ম হতে বিরত থেকে নামায, দুআ, যিকির ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকা ৷ তবে খাওয়া যাবে না, মাছ-গোশত বা কোন কিছু কাটা যাবে না, বাইরে বের হওয়া যাবেন মর্মে যেসব নিষেধাজ্ঞা সমাজে প্রচলিত রয়েছে এগুলোর কোন ভিত্তি নেই ৷ এসব কথা বিজাতীয় কুসংস্কার বৈ কিছুই নয় ৷
হাদিসের সূর্যগ্রহণ প্রসঙ্গে অনেক বর্ণনা রয়েছে। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,
عن المغيرة بن شعبة : انْكَسَفَتِ الشَّمْسُ يَومَ ماتَ إبْراهِيمُ، فَقالَ النّاسُ: انْكَسَفَتْ لِمَوْتِ إبْراهِيمَ، فَقالَ رَسولُ اللَّهِ ﷺ: إنَّ الشَّمْسَ والقَمَرَ آيَتانِ مِن آياتِ اللَّهِ، لا يَنْكَسِفانِ لِمَوْتِ أحَدٍ ولا لِحَياتِهِ، فَإِذا رَأَيْتُمُوهُما، فادْعُوا اللَّهَ وصَلُّوا حتّى يَنْجَلِيَ.
- ( صحيح البخاري: ١٠٤٣ ) হযরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, ‘হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতে সূর্যগ্রহণ হয়। তখন সবাই বলাবলি করছিলো যে, নবী করিম (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুর কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে দু’টি নিদর্শন, কারও মৃত্যু বা জন্মের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। যখন তোমরা সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগহণ দেখবে, তখন আল্লাহকে ডাকো এবং নামাযে রত হও যতক্ষণ না (গ্রহণ দুর হয়ে সূর্য-চন্দ্র) মুক্ত হয় ৷
–সহিহ বুখারি: ১০৪৩
আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ، قَالَ: خَسَفَتِ الشَّمْسُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَخَرَجَ يَجُرُّ رِدَاءَهُ، حَتَّى انْتَهَى إِلَى المَسْجِدِ وَثَابَ النَّاسُ إِلَيْهِ، فَصَلَّى بِهِمْ رَكْعَتَيْنِ، فَانْجَلَتِ الشَّمْسُ، فَقَالَ: «إِنَّ الشَّمْسَ وَالقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ، وَإِنَّهُمَا لاَ يَخْسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ، وَإِذَا كَانَ ذَاكَ فَصَلُّوا وَادْعُوا حَتَّى يُكْشَفَ مَا بِكُمْ»
- (صحيح البخاري: ١٠٦٣ )
হযরত আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে কাছে সূর্যগ্রহণ শুরু হলো ৷ রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করেন ৷ লোকেরাও মসজিদে চললো । তিনি সকলকে নিয়ে সূর্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত দু’রাকাত নামায আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে দু’টি নিদর্শন ৷ কারো মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন এ অবস্থা কেটে যাওয়া পর্যন্ত নামায আদায় করবে এবং দোয়া করতে থাকবে।’
–সহিহ বুখারি: ১০৬৩
عَنْ أَبِي مُوسَى، قَالَ: خَسَفَتِ الشَّمْسُ فِي زَمَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَامَ فَزِعًا يَخْشَى أَنْ تَكُونَ السَّاعَةُ حَتَّى أَتَى الْمَسْجِدَ، فَقَامَ يُصَلِّي بِأَطْوَلِ قِيَامٍ وَرُكُوعٍ وَسُجُودٍ، مَا رَأَيْتُهُ يَفْعَلُهُ فِي صَلَاةٍ قَطُّ، ثُمَّ قَالَ: «إِنَّ هَذِهِ الْآيَاتِ الَّتِي يُرْسِلُ اللهُ لَا تَكُونُ لِمَوْتِ أَحَدٍ، وَلَا لِحَيَاتِهِ، وَلَكِنَّ اللهَ يُرْسِلُهَا، يُخَوِّفُ بِهَا عِبَادَهُ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْهَا شَيْئًا، فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ، وَدُعَائِهِ، وَاسْتِغْفَارِهِ».
-(صحيح مسلم: ٩١٢ )
হযরত আবু মুসা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) -এর যুগে সূর্যগ্রহণ হলো ৷ তখন তিনি এই আশঙ্কায় উঠে দাঁড়ালেন যে, কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি দ্রুত মসজিদে চলে আসেন। এরপর অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু ও দীর্ঘ সিজদার সঙ্গে নামায আদায় করেন। আমি আর কখনো তাঁর নামায এমন (দীর্ঘ) দেখিনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর এসব নিদর্শনাবলি কারও মৃত্যুর কারণে হয় না, কারও জন্মের কারণেও হয় না। তিনি এগুলো প্রেরণ করেন তার বান্দাদের সতর্ক করার জন্য। যখন তোমরা এসব নিদর্শনাবলির কিছু দেখতে পাও তখন তোমরা আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহর যিকির, দুআ ও ইস্তিগফারে ব্যস্ত হও। -সহিহ মুসলিম: ৯১২
অধিকাংশ সময়ই আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত আনন্দ আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ প্রত্যক্ষ করে থাকেন। অথচ বিষয়টি মোটেও আনন্দের নয়, ভয় ও ক্ষমা প্রার্থনার মুহূর্ত।
সূর্য ও চন্দ্র যখন গ্রহণের সময় হয় নবী করিম (সা.)-এর চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেতো। তখন তিনি সাহাবিদের নিয়ে জামাআতে নামায পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
সূর্যগ্রহণের নামাযের পদ্ধতি হলো, স্বাভাবিকভাবে দু রাকাআত নামায আদায় করবে ৷ তবে কিয়াম, রুকু, সিজদাগুলো দীর্ঘ করবে ৷
(বাদায়েউস সানায়ে ১ঃ২৮০ – শামেলা ভার্সন)
আমাদেরও উচিত এই সময়টাকে উৎসবের মুহূর্ত না বানিয়ে আল্লাহর স্মরণে ও তার সাহায্য কামনায় ‘কুসুফের নামায’ আদায় করা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতে এটা আরও বেশি দরকার।