সন্তানকে শিষ্টাচার শেখানোর ফজিলত

আসিফ আহমাদ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদিসে বলেছেন,
كل مولود يولد على الفطره فابواه يهودانه او ينصرانه او يمجسانه
অর্থাৎ, প্রত্যেক শিশুর জন্ম হয় ইসলামী স্বভাবের উপর। অতঃপর তার বাবা-মা তাকে হয়তোবা ইহুদি বানায় অথবা খ্রিস্টান বানায় কিংবা অগ্নিপূজক বানায়। (মুসলিম)
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা মাতা এবং নিকটাত্মীয়দেরকে-যারা শরীয়তের পক্ষ থেকে শিষ্টাচার প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেছেন-
“علموا اولادكم السياحه والرماية والمراه المغزل
অর্থাৎ-তোমাদের সন্তানদেরকে সাঁতার এবং তিরন্দাজি শিখাও। আর তোমাদের মেয়েদেরকে চরকা চালানো শিখাও।
সন্তানদের তরবিয়ত এবং শিষ্টাচার শেখানোতে অনেক সওয়াব এবং ফজিলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন,
ما نحل والد ولد افضل من ادب حسن
অর্থাৎ, পিতার পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য সবচেয়ে উত্তম উপহার হল তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া।(তিরমিজি)
অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, প্রত্যেকদিন অর্ধ সা(আরবি পরিমাপ বিশেষ) মিসকিনদেরকে দান করার চাইতে নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার শিখানো অধিক উত্তম
অপর একটি হাদীসে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরাতো পিতা-মাতার হক জানতে পারলাম। তবে আমাদের উপর সন্তানদের কি হক আছে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, তুমি তার সুন্দর নাম রাখবে এবং উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, ادّب ابنك ،فانك مسؤول عنه ماذا ادبته،وماذا علمته؟وهومسؤول عن برك و طواعتيه لك
অর্থাৎ, “নিজের সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা দাও, তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে যে তোমরা তাদেরকে কি শিক্ষা দিয়েছ? আর সন্তানদের প্রতি প্রশ্ন হবে যে তারা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করেছে নাকি অসদাচরণ?”

সুতরাং, পিতা-মাতা যদি সন্তানদের তরবিয়ত ও শিষ্টাচার শিক্ষাদানে ত্রুটি করেন, তাহলে তারা অবশ্যই গুনাহগার ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত আমানতের খেয়ানতকারী হবেন। অথচ এ ব্যাপারে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ কারণে কুরআন মাজীদে এ ব্যাপারে পিতামাতাকে ভয় দেখানো হয়েছে। এবং তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদেরকে এবং নিজেদের সন্তানদেরকে গুনাহ থেকে বেঁচে রাখে এবং সৎকর্ম করে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ!নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর সেই আগুন থেকে যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। তাতে নিয়োজিত আছে কঠোর স্বভাব, কঠিন হৃদয় ফেরেশতাগণ,যারা আল্লাহর কোন হুকুমে তাঁর অবাধ্যতা করে না এবং সেটাই করে যার নির্দেশ তাদেরকে দেওয়া হয়। (সূরা তাহরীম-৬)
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন যে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে ইলম ও আদব শিক্ষা দাও।
হযরত হাসান বসরী বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের আদেশ করো এবং ভালো মন্দ শিক্ষা দাও।
অনেক আলিম একথা বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন পিতাকে তার সন্তানের ব্যাপারে আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরপর ছেলেকে পিতা মাতার ব্যাপারে। এজন্য কুরআনুল কারীমে পিতামাতাকে প্রথমে ওসিয়াত করা হয়েছে।। কুরআনুল কারীমে আরও ইরশাদ করা হয়েছে যে, তোমরা অভাবের ভয়ে সন্তানকে হত্যা করোনা।
এছাড়াও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اعدلوا بين اولادكم في النحل كما تحبون ان يعدلوا بينكم في البر واللطف
অর্থাৎ, হে লোকসকল, তোমরা নিজেদের সন্তানদের মাঝে উপহার বন্টনে সমতা রাখ। যেমন তোমরা নিজেরা তাদের উত্তম ব্যবহার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমতা আশা করো।
পিতা-মাতার তরবিয়তের প্রভাব
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে পিতা-মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু অনেক পিতা-মাতা এসব দায়িত্বে অবহেলা করে গুনাহের বোঝা বহন করে চলেছেন। বর্তমানে অনেক পিতা মাতা এসব দায়িত্বে চরম অবহেলা করেন। সন্তানদেরকে বাধাহীন ছেড়ে দেন। এ কারণে একসময় দেখা যায় যে সন্তানরা খারাপ স্বভাব গ্রহণ করে। নিজেদের মুরব্বিদের বেকার এবং অগ্রহণযোগ্য ভাবতে শুরু করে। পাশ্চাত্যের অনুসরণ করতে থাকে। কোন প্রকারের চিন্তা ভাবনা ছাড়াই পাশ্চাত্যের অনুকরণে চলতে শুরু করে। তাদের মত বেহুদা সাজসজ্জা এবং সুরত বানিয়ে রাখে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেয় না। অসৎ সংসর্গ এবং খারাপ লোকদের কাছে যাওয়া আসা, বৈধ অবৈধ প্রত্যেক চাহিদা পূরণ করা, নপুংসকদের মত পোষাক-পরিচ্ছদ ও আচরণ, চুলের আজব স্টাইল এবং সিথী তাদের কাছে সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যেন, এ ব্যাপারেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لتتبعن سنن الذين من قبلكم شبرا بشبر وذراعا بذراع حتى لو دخلوا حجر ضب لتبعتموهم ،قلنا ليهود والنصارى؟قال فمن؟
অর্থাৎ, তোমরা অবশ্যই (ভুল রাস্তায় চলার ব্যাপারে) পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে। এমনকি এক বিঘত যেমন অন্য বিঘতের এবং একহাত অন্যহাতের সমান হয় (তোমরাও তেমনি ভুল পথের অনুসরণে সমান সমান হবে)। এমনকি তারা যদি কোন গুই সাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুল আল্লাহ! তারা কি ইহুদী-নাছারা? নবীজী উত্তর দিলেন, তবে আর কারা!
আমরা সবাই জানি, বর্তমানে অবস্থা এত খারাপ যে এসব অবস্থা পিতা-মাতার সামনে প্রকাশ্য। অথচ তারা দ্বীনদারীর দাবি করেন। তাদের এই দাবি ভুয়া । ইসলাম মেনে চলার কথা বলেন কিন্তু সন্তানদের এসব কর্মকাণ্ডে তাদের অনুভূতি বিন্দুমাত্র খারাপ হয় না। অন্তরে রাগ করেন না এবং সন্তানদের প্রতি কোন উপদেশও দেন না। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এত খারাপ হয় যে অনেক পরে যখন পিতা-মাতার মধ্যে কেউ সন্তানকে কোন বিষয়ে উপদেশ দিতে চান তখন সন্তান মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এ পরিস্থিতির কারণ হচ্ছে,সঠিক সময়ে সন্তানের তরবিয়তের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া হয়নি।যদি পিতা-মাতা সঠিকভাবে তরবিয়ত এবং শিষ্টাচার শেখানোর প্রতি মনোযোগী হতেন তাহলে আজ অবস্থা এতটা খারাপ হতো না।
সন্তানের তরবিয়তে গাফলতির ক্ষতি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, كفى بالمرء اثما ان يضيع من يقوت অর্থাৎ, মানুষের গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট যে, যার রুজির ব্যবস্থা সে করে তাকে নষ্ট করে ফেলে। (আবু দাউদ)
এই হাদিসের প্রতিফলন আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। এই সন্তান-শৈশবে বাবা-মা যার প্রতিপালন করেছেন, তার জন্য রাতের পর রাত জেগেছেন, ‘সন্তানের যাতে কষ্ট না হয়’ এই চিন্তা করে তার জন্য হালাল হারাম না বেছে সব উপায়ে উপার্জন করেছেন, যাতে সন্তানের ভবিষ্যৎ আশঙ্কামুক্ত হয়। সাথে সাথে বাবা-মা এটাও কামনা করেছেন যে তাদের সন্তান তাদের জন্য যেন সুনাম বয়ে আনে। অথচ শেষে দেখা যায় যে তাদের সব আশা ভরসা ধুলোয় মিশিয়ে যাচ্ছে। সন্তান বাবা-মার সাথে সদাচরণ করছে না। সন্তান বাবা-মার দ্বীন মেনে চলার উপদেশের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করছে না। এমনকি অবস্থা এতটা খারাপ হচ্ছে যে, সন্তান হারাম স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য মা-বাবা থেকে পৃথক থাকছে। আর মা বাবা আশায় আশায় দিন পার করছেন। সমাজে এই চিত্র এখন অহরহ।
আমরা মনে করি, শৈশবে সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা না দেওয়াই এর কারণ।(চলবে ইনশাআল্লাহ)

Leave a Reply