ইমাম আমের বিন শুরাহবিল শা’বী (রাহ.) মালেক বিন মুয়াবিয়াকে লক্ষ করে বললেন : ‘তোমরা প্রবৃত্তি-পূজারী রাফেজীদের ভয় করো। কেননা তারা এ উম্মতের ইহুদি-সাদৃশ্য। ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের যেরূপ ঘৃণা করে, ইসলামের বিরুদ্ধে রাফেজীদের ঘৃণা সেরকমই। তাদের ইসলাম গ্রহণ আল্লাহর আশা-ভয়ে নয়, বরং মুসলমানদের বিরোধিতায়, ছলনাচ্ছলে’।
উক্ত ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা টেনে “ইকদুল ফরিদ” গ্রন্থকার বলেন : ইসলাম- নামধারী বিভিন্ন দল-উপদল তৈরিতে ইহুদিদের প্রভাব অসামান্য ছিলনা। ইসলামি ইতিহাসের পাতায় ইহুদি-মাজুসিদের ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন দৃশ্যপট আমরা দেখি :
উমর (রাযি.) এর হত্যাকাণ্ড।
আব্দুল্লাহ বিন সাবার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।
ইলহাদী, বাতেনী ও কারামেতা আন্দোলনের নেতৃত্বদান।
কোরআন-সুন্নাহের ব্যাখ্যায় যাহের-বাতেনের বিভক্তিকরণ।
বিদাআত ও কুসংস্কারের প্রচলন।
পৌরাণিক ঘটনা ও দুর্বোধ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে কোরআনের তাফসির।
সর্বেশ্বরবাদ ও ইশরাকি দর্শনের উদ্ভাবন।
প্রথম যুগ থেকেই ইহুদি-ষড়যন্ত্রের প্রধান অভিলক্ষ্য হয়ে ইসলাকে অভ্যন্তরীণ ভাবে, চিন্তাবৃত্তি ও মতাদর্শের দিক থেকে ধ্বংস করা করা। একারণে জনসাধারণের মাঝে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা ও বিভিন্ন কুসংস্কার প্রচলনের মাধ্যমে তাদের ইসলামি চেতনার বিলুপ্তি ঘটায়। এটাই মুসলমানদের আত্মিক সুগঠন ও ইসলামের সঠিক সমাজনীতির পথ থেকে তাদের সরিয়ে নেয়।
ইসলাম দ্বিপ্রান্তিকতার মাধ্যমে যার সমন্বয় করেছিল, ইহুদি আদর্শবাদ উভয়ের মাঝে পার্থক্যের মাধ্যমেই এ সব ভ্রান্ত মতাদর্শের প্রচলন ঘটায়। কোন কোন মতবাদের ক্ষেত্রে যুক্তিপ্রাধান্য আবার কোন ক্ষেত্রে অনুভূতি ও বোধশক্তির প্রাধান্য।
পূর্বযুগ থেকে মুসলমান এ সব মতাদর্শের প্রচলন শুরু হয়। কেননা এতে প্রবৃত্তি পুরণের সুযোগ। নিয়মনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে নিজেকে মুক্ত দিয়ে লাগামহীন জীবনযাপনে গা ভাসিয়ে দেয়। বর্তমান যুগেও আমরা এসবের দ্বিরুক্তি দেখি। শরিয়তের কিছু বিধান পালন করে, আবার কিছু বিধান পালনের ক্ষেত্রে নিজেকে সুউচ্চ মনে করে। অনেকে আবার ইবাদাতের ক্ষেত্রে ইসলামের ধার ধরে, কিন্তু মুআমালাত ও মুআশারাতের ক্ষেত্রে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পাশ কাটিয়ে যায়।
বর্তমানে অনেক লেখকের ক্ষেত্রে পূর্বের ভ্রান্ত মতবাদ সমূহের মিশ্রণ পাওয়া যায়। তাদের মতাদর্শের মূলে থাকে মুতাযিলা, বাতেনিয়্যা, সুফীয়্যা ও ফালসাফার প্রভাব। এটাকেই ইসলাম বলে মনে করে। তাদের ক্ষেত্রে ত্রুটি হলো, প্রথম চার শতকে ইসলামি চিন্তাবৃত্তি বিভিন্ন মতবাদ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে যে ক্রমবিবর্তনের সম্মুখীন হয় তার দিকে সামগ্রিক দৃষ্টি না দিয়েই যে কোন মতাদর্শের আদলে ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে।
ই’তিজাল ( মু’তাজিলা মতবাদ), কালামশাস্ত্র ( দর্শনের দৃষ্টিকোণে ধর্মত্বত্ত্ব) , শিয়া ও সুফিবাদ সবগুলো মতাদর্শই একপ্রান্তিক। ইসলামে যুক্তির মূল্যায়ন আছে, গুরুত্ব আছে আত্ম-অনুভুতির, রয়েছে “আহলে বাইতে”র যথাযোগ্য সম্মান। ইসলাম নিছক যুক্তি নয়, যেমনটা মুতাযিলরা মনে করে থাকে আবার নিছক অনুভূতি-প্রবণতাও নয় যেমনটা সুফিরা বলে থাকে।
অনেক লেখক-গবেষক যারা প্রাচ্যবিদ ও মিশনারীদের সুযোগ্য হাতের লালিত বা পশ্চিমায়নবাদী, তারা “মুতাজেলা-পতন”কে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা বা অনগ্রসরতা বলে থাকেন। ইসলাম নিয়ে তাদের বাস্তব জ্ঞান ও সঠিক উপলব্ধি না থাকার কারণে। আবার কখনওবা সে উপলব্ধি পাশ্চাত্য চিন্তাধারা আদলে।
বাস্তব হচ্ছে, মুতাজিলা-পতন স্বাভাবিক ফলশ্রুতি ছিলো। কেননা তাদের মতাদর্শের আহ্বানটা ইসলামি মূল্যবোধের সাংঘর্ষিক, ইসলামি চিন্তাবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যহীন। ইসলামের দ্বিপ্রান্তিক জ্ঞানধারাকে — যা আকল ও অনুভূতির সমন্বয় যাতে — তারা শুধু যুক্তি-সীমাবদ্ধ করেছিল।
মূলতঃ মুতাযেলা মতবাদের প্রতিষ্ঠা সে দার্শনিক মতবাদের প্রতিরোধে ছিল, যার আড়ালে ইসলাম-প্রতিপক্ষ সকল ধর্মের আত্মরক্ষা ছিলো। তারা সে ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে সুন্দরভাবে, এটা ঠিক। কিন্তু যুক্তি-প্রাধান্যের কারণে নিজের সমুচ্চ স্থান করে নিতে পারেনি। কেননা তাদের মতিগতি সঠিক ইসলামি উপলব্ধির বিপরীত। তাই সঠিক ইসলামি উপলব্ধির বার্তাবাহী হয়ে ইমাম আহমদ ও আশআ’রী আসলেন। কেননা সেসময়ে এর যথাযথ প্রয়োজন ছিল। গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশের ফলে মুসলমানদের মতাদর্শ-বিকৃতির গ্লানি থেকে তাদের প্রচেষ্টা যথোপযুক্ততা ছিল। কখনওবা মুতাযিলা-পতনের ক্ষেত্রে পাশ্চীমাদের আক্ষেপ ছিলো এজন্য যে, ই’তিযাল গ্রীকদর্শনের মানসসন্তান ও অনুসারী ছিলো। তার সর্বপ্রসারে ইসলামি মূল্যবোধের বিনষ্টের মুখ দেখত। কিন্তু ইসলামের মৌলিকত্ব গ্রীকদর্শন-ধারা থেকে সুউচ্চ ছিলো। একারণে বর্তমানে ই’তেযালি চিন্তাধারা নিয়ে আরব্য চিন্তাবৃত্তির নতুনত্বের নামে যে আন্দোলন চলছে, তা ফলপ্রসূ হবেনা।
এমনিভাবে মুসলমানদের মাঝে ভ্রান্ত আকীদা অনুপ্রবেশের দ্বিরুক্তি ঘটে কোরআনের বাতেনী তাফসিরের ক্রমধারায়। সাথে সাথে জুড়ে দেওয়া হয় পৌরাণিক-অলীক বিভিন্ন ঘটনা। এর সূত্র ধরেই কারামেতা, সাবিইয়্যা মতবাদ ও ইখওয়ানুস সাফার মতো দার্শনিক গোষ্ঠী উদ্ভব হয়।
আখেরাত-প্রতিদানকে আধ্যাত্মিক বলা, জান্নাত-জাহান্নামকে আত্ম-অনুভূতি বলা; এসবের অজুহাত দেখিয়ে শরিয়তের নিয়মনীতি ও অনুশাসনের আবশ্যকতা পরিহার করাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে তাদের দালিলিক গ্রন্থের সিরিয়ালে থাকে দর্শন ও সুফিবাদ মিশ্রিত বিভিন্ন পুস্তিকা, ইখওয়ানুস সাফার রিসালা সমূহ, ইবনে রাউন্দি ও ইবনে মাকফা’র কিতাবাদী — ইসলামি চিন্তাবৃত্তির সাথে যাদের অবস্থান ছিলো সাংঘর্ষিক।
বর্তমানেও মুসলমানদের মানসপটে বিভিন্ন বিকৃত মতাদর্শ অবস্থান নিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক — সবক্ষেত্রেই সংকটের মুখোমুখি। যার কারণে ইসলামী সংস্কৃতির প্রকৃত রূপ যথার্থভাবে বিকশিত হচ্ছে না। ফলে বিশ্ব-সংস্কৃতির — কখনো তা পুঁজিবাদ, কখনো মার্কসবাদ, কখনো আবার জায়নবাদ — মূখে একাকার হয়ে যাওয়ার অবস্থা। অথচ ইসলাম এসবের বিপক্ষে ইসলামের অবস্থান পর্বত সাদৃশ্য — তা বিগলিত হবেনা, একাকার হবেনা, অন্য সভ্যতার উনুনে ভস্মিত হবেনা।
তাই আমাদের পরভাববাদের গণ্ডি ছাড়তে। ইসলামের মৌলিকত্বে জীবন সাজাতে হবে। এটাই বর্তমানের সকল বিকৃত মতাদর্শের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে আমাদের উপর্যুপরি কাজ দেবে। কুরআন আমাদের সে মূলনীতি শেখায় : “আর ইয়াহুদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন” (বাকারা : ১২০) “আর তারা সবসময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে না দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়” ( সূরা বাকারা : ২১৭) ‘তারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তো তারা তোমাদেরকে পাথরের আঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের মিল্লাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে তোমরা কখনো সফল সফল হবে না’ ( সূরা কাহাফ : ২০) “হে মুমিনগণ! যদি তোমরা কাফেরদের আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদেরকে বিপরীত দিকে ফিরিয়ে দেবে ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৯)
আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন।