মেঘের দিনের ডায়েরি

লেখক:মাওলানা রফিকুল ইসলাম

ছাদে ধান ছড়ানো৷ বাড়িতে কেউ নেই আমি ছাড়া৷ বাবা পানের বরোজে, ছোট ভাইকে তো পাওয়াই যায় না৷ আম্মাও যে কোথায় গেল৷ বৃষ্টি নামি নামি করছে৷ দক্ষিণাকাশ মেঘাচ্ছন্ন৷ বাতাসের ঈষৎ ঝাপটায় দরজা-জানালা বাড়ি খাচ্ছে৷ সবকিছু দেখে দাদি বললেন, রফিক, বৃষ্টি অইব৷ ধান তুলতে যা৷ দক্ষিণাকাশে মেঘ থাকলে বৃষ্টি অয়৷ তাড়াতাড়ি যা৷

আগের দিনের মানুষদের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ঋদ্ধ৷ সব কাজে তাদের সতর্কতা, নানান রোগের ঔষধ-জ্ঞান, ভিবিন্ন চিন্তাপ্রবাদ সব কিছুতেই তারা পাকা৷ বর্তমান মেয়েরা এর ধারে-কাছেও নেই৷

প্রথমে বৃষ্টি হবে না মনে হলেও দাদির কথায় ছাদে গিয়ে পায়ে ঠেলে ধান দলা করতে লাগলাম৷ দলাকৃত ধান গম্বুজের মতো হলে ঝাঁটা দিয়ে বাকি ধান একত্র করে বস্তাবন্দী করে ফেলার পরই হন্তদন্ত হয়ে আম্মুকে কোত্থেকে ছুটে আসতে দেখলাম৷ এসেই ঝাঁটা তালাশ করছেন৷
ছাদ থেকে আওয়াজ দিলাম, ‘আম্মু কি খুঁজছো?’ -‘ঝাঁটা৷’
-‘কেন?’
-‘ছাদে ধান ছড়ানো ছিলো৷’
-‘আমি বস্তাবন্দী করে ফেলেছি৷ তোমাকে আসতে হবে না৷’ আম্মু কী যে খুশী হয়েছেন! পাশে থাকা প্রতিবেশী চাচির সাথে আমার প্রশংসালাপ জুড়ে দিয়েছেন৷ বাবা মা’র কাজ-কর্মে সন্তানের সাড়া পেলে উনারা যে কি খুশী হন, দোয়া করেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ অথচ আমি কাজই করি না৷ সংসারের টুকটাক কাজ ছোট ভাই করে, বাকিসব মজুর দিয়ে করানো হয়৷ কোথায় কয়টা জমি আছে, কোন জমি ভাগে, কোনটা বর্গা, কোনটা নিজস্ব জমি এখনো ভালোরকম জানিই না৷ আস্ত একটা কুঁড়ে বলা যাবে আমাকে৷ অসল বললে ভাব আদায় হবে না৷

দুপুর গড়িয়ে বিকাল৷ আকাশ তখনো মেঘেদের দখলে৷ মেঘেরা রাজত্ব করছে আকাশে৷ ভারি বর্ষণ হতে পারে৷ বিকালেও বাড়িতে কেউ নেই৷ ছোট ভাই ফরমায়েশ করে চলে গেছে—বৃষ্টি নামলে কাপড়চোপড় ঘরে নিয়েন, মটার চালানো আছে কিছুক্ষণ পর অফ করে দিয়েন, আমি যাচ্ছি৷ মানে জমিদারি ভাব৷ মনে হচ্ছে অফিসিয়াল কাজে যাচ্ছে৷ কিছুই না, আড্ডা দিতে বেরুচ্ছে৷ আড্ডার সময় নাকি চলে যাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ির অদূরে বৃক্ষসুশোভিত ছায়াঢাকা একটি বাড়ির সামনে মাচাংয়ে বসে তারা রোজ রোজ আড্ডা জমায়৷ রাতদুপুরে আড্ডায় মজে থাকে তারা৷ গল্পের ঝাঁপি খুলে দেয় মাচাংয়ে বসে৷
আজকের আড্ডা সুবিধা করতে পারেনি৷ বৃষ্টি নেমে সব তছনছ হয়ে গেছে৷ মাচাং ভিজে গেছে৷ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সবাই যার যার বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে৷ বৃষ্টি তাহলে মানুষকে অহেতুক কাজ থেকেও বাঁচায়৷

সন্ধ্যা নামি নামি৷ সূর্য নেই আকাশে সেই দুপুর থেকেই৷ বাবা বরোজ থেকে এলেন৷ খারাপ সংবাদ নিয়ে ফিরলেন পানের বরোজ থেকে৷ কি হয়েছে? বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে৷ পানক্ষেতে অষুধ দেওয়ার কথা ছিলো৷ সময় মতো দিলামও৷ কিন্তু বৃষ্টির ঢলে অষুধ ধুয়েমুছে সব নর্দমা হয়ে ক্ষেতের বাইরে চলে গেছে৷ হাজার টাকার অষুধ৷ তার উপর শারীরিক কসরত তো আছেই৷ এখন হবে কি? বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন৷ কিন্তু সবার মতো আল্লাহকে অভিশাপ দিচ্ছেন না৷ আজকাল প্রাকৃতিক কোন কারণে মানুষের ক্ষতি হয়ে গেলে আল্লাহকে দু’কথা শুনিয়ে দেয় মানুষ৷ বৃষ্টির আর সময় ছিলো না, অসময়ে বৃষ্টি দিলেন কেন আল্লাহ? আল্লাহ বুঝি আমাকেই বিপদে ফেললেন, জগতে আর মানুষ ছিলো না৷? ইত্যাকার নানান অভিযোগ তারা আল্লাহর ব্যাপারে করে থাকে৷
কিন্তু আমি আশৈশব আব্বু কিংবা আম্মুর মুখ থেকে এ-ধরণের কোন কথা শুনিনি৷ বরং বিপদেও আল্লাহর গজবের উপর সন্তুষ্ট থেকে পাহাড়াসম ধৈর্যধারণ করতে দেখে আসছি৷ পৃথিবীর সবাইকে আল্লাহ পাক এই গুণটি দান করুন৷ আমীন৷

Leave a Reply