ইসলামে পর্দার বিধান

লেখক: শাকির মাহমুদ বিন রফিক

ইসলাম ধর্মে ও একটি আদর্শ পরিবার, সমাজ বা জাতি গঠনে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম।কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে,ওয়েস্টার্ন কালচার এবং বিজাতিয় নোংরা সভ্যতার প্রতিযোগীতামূলক চর্চার ফলে শরীয়াহ এর এই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানটি আজ আমাদের সমাজে বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও অপব্যাখ্যায় জর্জরিত।
একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামের অতিব গুরুত্বপূর্ণ এবিধান সম্পর্কে স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও সঠিক ধারণা থাকা এবং এর সাথে -সাথে অধিনস্থ মা -বোনদের এ বিষয়ে সতর্ক করা আমাদের জন্য একান্ত বাঞ্ছনীয়। সেই মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ক্ষুদ্র এই প্রয়াস।(আল্লাহ তায়াল কবুল করুন।)

পবিত্র কুরান ও হাদিসে পর্দার যে বিধান এসেছে তা তিনটি স্তরে বিভক্ত।আর এর প্রত্যেকটি স্তরই আজো বলবৎ আছে তথা রহিত হয়নি।তবে হ্যাঁ, বিভিন্নক্ষেত্রে মহিলাদের উপর বিভিন্ন স্তরের হুকুম আরোপিত হয়ে থাকে।

উল্লেখিত তিনটি স্তর এর ব্যাখ্যা, দলিল ও হুকুম নিম্নরূপ।

১.প্রথম স্তর তথা সর্বোৎকৃষ্ট স্তর।

আর তা হল,মহিলারা তাদের পুরা সত্ত্বাকে ঘরের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখবে যাতে তাদের পর্দাবৃত আকৃতিও কোন পরপুরুষের দৃষ্টিগোচর না হয়।

দলিল:

১.পবিত্র কুরানে এসেছে “এবং তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর“।
(সূরা আহযাব, আয়াত ৩৩।)

২.অন্যত্র এসেছে “এবং যখন তোমরা তাঁদের ( রাসূল সা. এর স্ত্রীগণ) থেকে কোন জিনিস চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও।
(সূরা আহযাব, আয়াত ৫৩)

৩.অনুরূপভাবে হাদিস শরীফে এসেছে।
“হজরত ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত হুজুর সা. বলেন: মহিলারা লুকানোর বস্তু। যখন তারা বাহিরে বের হয় তখন শয়তান তাদের দিকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে।”
( তিরমিজি শরিফ)
৪. “হজরত জাবের রা. হতে বর্ণিত হুজুর সা. বলেন নিশ্চয় মহিলারা শয়তানের রূপে সামনে আসে এবং শয়তানের রূপেই প্রস্থান করে।”
( মুসলিম ১ম খন্ড,১২৯ পৃ)
৫. “হজরত ইবনে উমর রা. থেকে মরফুয়ান বর্ণিত: মহিলাদের একান্ত অপরাগতা ব্যতীত ঘর থেকে বের হবার কোন অনুমতি নেই।”( কানঝুল উম্মাল,৮/২৬৩)

৬. “হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত: উনি বলেন যে পর্দার হুকুম অবতীর্ণ হবার পর হজরত সাওদা রা. প্রকৃতির ডাকে সারা দেবার জন্য ঘর হতে বাহির হলেন।যেহেতু তিঁনি স্বাস্থ্যবতী ও সাধারণ মহিলাদের তুলনায় লম্বা ছিলেন তাই পরিচিত লোকেরা তাঁকে ঠিকই চিনে ফেলতো।সুতরাং তিনি যখন বের হলেন তখন হজরত উমর রা. তাঁকে দেখলেন এবং বললেন,হে সাওদা রা. তুমি আমাদের থেকে নিজেকে গোপন করতে পারবে না।অতএব ভেবে দেখো তুমি কিভাবে বের হবে??হজরত আয়েশা রা. বলেন, একথা শুনে হজরত সাওদা রা. ঘরে ফিরে এলেন এমতাবস্থায় যে, হুজুর সা. আমার ঘরে সন্ধ্যার খাবার খাচ্ছিলেন।হুজুর সা. এর হাতে গোস্ত যুক্ত একটি হাঁড় ছিল। সাওদা রা. ঘরে প্রবেশ করলেন এবং ঘটনার বিবরণ দিলেন।আয়েশা রা. বলেন হুজুর সা. এর উপর ওহী অবতীর্ণ হওয়া শুরু হল এবং হাঁড়টি হাতে থাকা অবস্থাই তা শেষ হল এবং হুজুর সা. বললেন তোমরা মহিলাদের প্রয়োজনে বাহিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
( সহিহ মুসলিম, কিতাবু সসালাম)
উক্ত হাদিস থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে মহিলাদের ঘর থেকে বাহিরে যাবার অনুমতি প্রয়োজনের সাথে সীমাবদ্ধ। প্রয়োজন ব্যতিরেকে মহিলারা আপন ঘরেয় অবস্থান করবেন।

৭. “হজরত ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত: রসূল সা. বলেন,মহিলাদের স্বীয় ঘরের অভ্যন্তরীণ কুঠিরে নামাজ পড়া ঘরের ভিতরে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম এবং ঘরের ভিতরে নামাজ পড়া আঙিনায় নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।” ( আবু দাউদ শরিফ)

যে সকল মহিলার ক্ষেত্রে এ স্তরের পর্দা প্রযোজ্য :

পর্দার এই সর্বোৎকৃষ্ট স্তরটি মহিলাদের স্বাভাবিক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় তারা স্বীয় ঘরেয় অবস্থান করবে ঘর থেকে বের হবে না।যাতে তাদের পর্দাবৃত অবয়বও কোন পরপুরুষের দৃষ্টিগোচর না হয়।

২.পর্দার দ্বিতীয় তথা মধ্যম স্তর।
আর তা হল,মহিলাদের সত্ত্বা, অবয়ব বা উপস্থিতি লুকানো আবশ্যক নয়।শুধু পুরা শরীর আবৃত করলেই হবে।

দলিল:

১. পবিত্র কালামে এসেছে:
” হে নবী (সা.) আপনি নিজ স্ত্রী ও কন্যাগণকে এবং অন্যান্য মুসলমানদের মহিলাদের বলে দিন যে, তারা যেন নিজেদের উপর চাদর ঝুলিয়ে নেয়।”
( সূরা আহযাব ৫৯)

২. হাদিস শরিফে এসেছে:
“”উম্মে খল্লাদ নামক এক মহিলা স্বীয় চেহারা নেকাবৃত অবস্থায় হুজুর সা. এর দরবারে উপস্থিত হলেন এবং নিজের শহিদ পুত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।একজন সাহাবী রা. উক্ত মহিলাকে বললেন তুমি নিজের সন্তানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেও নিজের চেহারাকে নেকাবৃত করে রেখেছো? উক্ত মহিলা জবাব দিলেন যদিওবা আমার পুত্রের উপর মুসিবত এসেছে কিন্তু আমার হায়া-শরমের উপর তো মুসিবত আসেনি।””
(আবু দাউদ শরিফ,কিতাবুল জিহাদ)

৩.” হুজুর সা. ঈদের দিন কুমারী, বিবাহিতা,হায়েযা এবং পর্দানশিন মহিলাদের ঈদগাহে নিয়ে যেতেন,কিন্তু হায়েযা মহিলারা ঈদগাহ থেকে দূরে থেকে দোয়ায় শরিক হতেন।একজন মহিলা হুজুর সা. কে জিজ্ঞাসা করলেন হে রসূল সা. যদি কাহারো কাছে বড় চাদর না থাকে তাহলে সে ঈদগাহে কিভাবে আসবে?? হুজুর সা. উত্তরে বললেন তার বোন তাকে নিজের চাদরে আবৃত করে নেবে।”
(তিরমিজি শরিফ)

৪. “হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন আমরা হুজুর সা. এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম,তখন লোকজনের বাহনগুলো আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল।যখন ঐ বাহনগুলো আমাদের নিকটে আসতো তখন আমরা নিজেদের চাদরগুলোকে নিজেদের চেহারার উপর লটকিয়ে নিতাম।আর যখন তারা চলে যেত তখন আমরা নিজেদের চেহারা খুলে ফেলতাম।” (আবু দাউদ, কিতাবুল হজ্ব)

উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, মহিলা সাহাবীগণ রা. পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর চাদর দ্বারা নিজেদের শরীর আবৃত করে রাখাকে আবশ্যক মনে করতেন আর প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে উক্ত চাদরকে নিজেদের চেহারার উপর লটকিয়ে দিতেন।আর শেষ হাদিস থেকে তো একথাও প্রমাণিত হয় যে, সাধারণ অবস্থায় তো বাহিরে বেরুলে চেহারা ঢাকতেনই এমনকি ইহরাম অবস্থায় যখন কিনা চেহারাকে কাপর দ্বারা আবৃত করে রাখা নিষেধ তখনো চেহারার পর্দাকে আবশ্যক মনে করতেন।

যে সকল মহিলার ক্ষেত্রে এ স্তরের পর্দা প্রযোজ্য :

পর্দার এ স্তর ঐ সকল মহিলাদের জন্য যাদের বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যাওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।তারা সমস্ত শরীর আবৃত করে বের হতে পারবে।তবে এক্ষেত্রেও পালকি বা অনুরুপ কোন বাহনে চড়েই চলাচল কাম্য যাতে পুরা সত্ত্বাই লুকায়িত থাকে।
৩. পর্দার তৃতীয় তথা সর্বনিম্ন স্তর।

আর তা হল,পুরা শরীর ঢাকতে হবে তবে ক্ষেত্রবিশেষে মুখ ও হাতের তালুও খোলা রাখতে পারবে।

দলিল:

১. পবিত্র কুরানে এসেছে
” হে নবী সা. আপনি মুসলিম মহিলাদের বলে দিন যে, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে আর আপন সৌন্দর্য কে যেন প্রকাশ না করে তবে যা উহা থেকে প্রকাশ হয়ে যায়।”(তা প্রকাশ হলেও সমস্যা নেই)
(সূরা নূর ৩১)
আর অধিকাংশ মুফাসসিরিনে কেরাম যা প্রকাশ হয় থেকে হাতের তালু ও মুখমণ্ডল উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

২. হাদিস শরিফে এসেছে:
“হজরত আসমা রা. হুজুর সা. এর দরবারে এ অবস্থায় আগমন করেন যে তার শরীরে পাতলা কাপড় ছিল।হুজুর সা. তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন হে আসমা!!যখন মহিলারা প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে যায় তখন তাদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে তাদের চেহারা এবং হাতের তালু ব্যতীত শরীরের কোন অংশ দেখা যায়।”(আবু দাউদ).

৩. “একদা জনৈকা মহিলা হুজুর সা. এর দরবারে আসলেন।অত.পর বললেন আমি নিজেকে আপনার কাছে সোপর্দ করে দেবার লক্ষ্যে আসিয়াছি।হুজুর সা. ঐ মহিলাকে উপর থেকে নিচে গভীরভাবে দেখলেন এবং দৃষ্টি অবনত করে মাথা ঝুকে ফেললেন।”( সহিহ বুখারি)
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে উক্ত সাহাবিয়ার চেহারা অনাবৃত ছিল।

৪. “হজরত ফজল ইবনে আব্বাস রা. হুজুর সা. এর সাথে একই সোয়ারীতে আরোহিত ছিলেন।এমতাবস্থায় একজন সুন্দরী মহিলা হুজুর সা. কে কোন একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো।হজরত ফজল রা. ঐ মহিলার দিকে দেখতে লাগলেন এবং তার সৌন্দর্য তাকে বিমোহিত করলো।হুজুর সা. যখন বিষয়টি টের পেলেন তখন ফজল রা. এর চিবুক ধরে তার চেহারাকে উক্ত মহিলা থেকে ফিরিয়ে দিলেন।”
( সহিহ বুখারি হা.৬২২৮)
উক্ত হাদিস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, ঐ সাহাবীয়ার মুখ খোলা ছিল।হুজুর সা. ফজল রা. এর চেহারা তো ফিরিয়ে দিয়েছেন কিন্ত মহিলাকে চেহারা ঢাকতে বলেননি।

যে সকল মহিলার ক্ষেত্রে এ স্তরের পর্দা প্রযোজ্য :

এ হুকুম ঐ সকল মহিলাদের জন্য যারা একান্ত প্রয়োজনে বাহিরে গিয়েছেন।তারা দুটি ক্ষেত্রে নিজেদের চেহারা বা হাত খুলতে পারবেন।
ক. এমন ক্ষেত্রে যে চেহারা না খুললে ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে।যেমন : প্রচণ্ড ভীড়ে চলাচলের সময় যে, ভালমত না দেখতে পেলে পড়ে গিয়ে ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশংকা আছে।অথবা অন্যকোন বিশেষ প্রয়োজনে যেমন: সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকের সামনে।
খ. কাজ-কর্ম করার সময় অনিচ্ছাকৃত খুলে গেলে।

সারকথা হল,

সাধারণ অবস্থায় মহিলাদের নিজ ঘরে অবস্থান করাই ফরজ, বাহিরে বের হওয়ার অনুমতি নেই। বিশেষ কোন প্রয়োজনে পুরো শরীর আবৃত রাখার শর্তে বের হতে পারবে।
আর ফেৎনার আশংকা না থাকার শর্তে বিশেষ প্রয়োজনে মুখ ও হাতের তালুও খুলতে পারবে।

বি.দ্র.
যেসকল ক্ষেত্রে মহিলাদের চেহারা বা হাত খোলার অনুমতি দান করা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও কিন্তু পুরুষের উপর দৃষ্টিকে অবনত রাখার আদেশ করা হয়েছে।তাই প্রয়োজনে চেহারা খুললেও পুরুষের জন্য দেখার অবকাশ নেই।

3 Replies to “ইসলামে পর্দার বিধান”

  1. মাশাআল্লাহ, অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং প্রয়োজনীয় লেখা।

  2. মা-শা-আল্লাহ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। আল্লাহ্‌ তায়ালা লেখককে উত্তম বিনিময় দান করুন। লেখকের কলমে বারাকাহ দান করুন। আ-মীন।

Leave a Reply