“পরভাববাদ” পশ্চিমায়নবাদীদের কার্যক্রমের সামগ্রিকতা ছয় ডিজিটের এ শব্দেই ফুটে ওঠে। মুসলমানদের নিজ-মৌলিকত্ব ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের পথ থেকে সরিয়ে বৈশ্বিক চিন্তাবৃত্তির গলনপাত্রে বিগলিত করার প্রচেষ্টাই তাদের মূখ্য।
ইসলাম; স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্বকীয়তা নিয়ে অনন্য, একই সুতোয় ধর্মীয় মতবিশ্বাস ও জীবনবৃত্তিক চিন্তাভাবনার সমন্বয়ক। তার বিপরীতে পাশ্চাত্য-চিন্তাবৃত্তিতে এ দু’য়ের মাঝে যোজন যোজন ফারাক। এখান থেকেই স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা দেখতে পাই উভয় চিন্তাবৃত্তির মাঝে। যার একটি গভীরমূলে প্রোথিত। মূলোৎপাটন বা বিদূরিতকরণ অসম্ভব। অন্যটি সেরূপ নয়। রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতার কারণে হয়তো মাঠ গরম তার। কিন্তু এ জ্বালানি শেষ হলে তবে নামটাও অবশিষ্ট থাকবেনা।
ইসলাম মৌলিকত্বের চাদরে জড়িয়ে আমাদের অন্ধানুসরণের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। উৎসাহ দিয়েছে সে চাদরের আবেশে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে। মুসলমানগণ যখন এ মৌলিকত্বের উপরে ছিলো, হাজারো বাধা-বিপত্তি ও বিঘ্নতার পথ মাড়িয়ে স্বশক্তিবলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। কোন সংকট বা চক্রান্ত-ধারা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। কিন্তু যখন এ স্বকীয়-ধারা থেকে তারা বিচ্যুত হয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে, তাদের বীরত্ব-ধারা ও শৌর্যবীর্যের আখ্যান পৌরাণিকতায় রূপান্তর হয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতি যাদুঘরের কাষ্ঠ-তাকে উঠে যায়।
বাস্তবিকপক্ষে মুসলমানদের এ অবনতির পেছনে বহিঃশক্তির হাত প্রত্যক্ষ ছিলো। তাদের বিভ্রান্তকরণে সোচ্চার ছিলো তাগুতের জোটশক্তি।
পূর্বে আমরা যুগ প্রেক্ষাপটে ইসলাম-বিরোধি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফাঁদে ফেলে মৌলিকত্বের পথ থেকে সরিয়েছিল। কখনো বিদাআ’ত-কুসংস্কারের অনুপ্রবেশ করে, কখনো বিদ্রোহী শক্তির সূত্রপাত ঘটিয়ে, কখনো বাতিল মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে তারা এসব করেছিল।
বর্তমানে তার সবধারাই অবশিষ্ট আছে। সাথে যুক্ত হয়েছে আরো নব্য ধারা। যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞানের স্লোগান। প্রগতিবাদ এবং বৈশ্বিক চিন্তার মানসপটে সকলকে একীভূত হওয়ার আহ্বান। বাস্তবে ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ নেই। যে সব ক্ষেত্রে এটা মনে করা হয়, তবে বিজ্ঞান সে বাস্তবতায় পৌছুতে পারেনি, যেখানে পৌছেছে ইসলাম। প্রগতিশীলতার সাথেও বিরোধ নেই ইসলামের, যদি তা হয় নৈতিকতার বাগডোরে আবদ্ধ। ইসলাম মানুষের একত্বের সমর্থক। কিন্তু তার প্রতিকৃতি যদি হয় ধর্মীয় মতাদর্শের জলাঞ্জলি দিয়ে, তবে ইসলামের সে একত্বের ঘোর বিরোধী।
বর্তমানে ইসলাম দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সেরা সময়ই অতিবাহিত করছে। মুসলমানদের সামনে দিন দিন প্রতিকৃতি পাচ্ছে নতুন নতুন মতাদর্শ, কর্ণগোচর হচ্ছে নতুন নতুন স্লোগান। ঈমান-একত্ববাদের গণ্ডি থেকে বের করার জন্য, ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার দায়হীন অনুভূতি তৈরি, পুনরুত্থান ও প্রতিদান দিবসের বিশ্বাসে বিভিন্ন অমুলক প্রশ্নের ছুতো দেখিয়ে সন্দেহের বীজ বপন করা হচ্ছে। পৌত্তলিকতা, বস্তুবাদ, নাস্তিক্য ও অশ্লীলতার আহবান। আরবি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন, আঞ্চলিকতার সয়লাব ঘটিয়ে বিশুদ্ধ আরবির মৌলিকত্ব বিনষ্টিকরণ। ধর্মবিশ্বাস, সভ্যতা-সংস্কৃতির ইসলামি উপলব্ধি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উৎক্ষেপণ, মুসলিম প্রতিপালন-নীতির ভুয়া অসারতার দেখিয়ে পাশ্চাত্যধারার ব্যাপক প্রসারের অপচেষ্টা। জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ফাটল ধরানো ও বিভক্তির প্রণোদনা, ধর্মনিরপেক্ষতার আওয়াজ তুলে ইসলাম-বিরোধীতার বীজ বপন। গল্প, উপন্যাস ও নাটকে পৌরাণিকতা ও অশ্লীলতার বীজ দিয়ে মনোভাব-বিকৃতি।
এসব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে জায়নবাদ, পশ্চিমায়নবাদ ও উপনিবেশিকদের হাত মূখ্য ছিল। কিছুটা সফলতার মুখও তারা পায়। যুবকদের মাঝেই এর কার্যত প্রভাব দৃশ্যত হয়। তাদের মুখরোচক স্লোগানে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মাঝেই নিজেদের মুক্তির পথ খুজতে শুরু করে। আর ইসলামি চিন্তাবৃত্তি হয়ে ওঠে সংকীর্ণতার আঁধার।
এখান থেকেই মুসলমানদের পরাজয়ের ধারা শুরু। বিদেশি মনোভাব আর পরভাববাদের লেজুড় ধরে নিজেদের যখন উন্নতচিন্তক মনে করে, অথচ এখান থেকেই তাদের পরাজিত মানসিকতার সূচনা ঘটে।
ইসলাম আমাদের মানব-সহজাত ইসলামী চিন্তাবৃত্তি এবং পৌত্তলিকতা ও বস্তুবাদের সংমিশ্রণজাত অন্যান্য চিন্তাবৃত্তির মাঝের পার্থক্য চোখে দেখিয়ে দেয়। পরভাববাদ, বিজাতীয় সংস্কৃতি ও পশ্চিমায়নের এ স্রোতে কুরআনী যে উপদেশের মান্যতা আমাদের মাঝে শতভাগ থাকার কথা ছিল, আজ তার কিঞ্চিতভাগও নেই আমাদের মাঝে। যদি থাকত, তবে এসবের বিপরীতে পাহাড়সম অবস্থান থাকতো আমাদের। কুরআন বলছে : “হে ঈমানদারগণ, তোমরা যদি আহলে কিতাব কোন গোষ্ঠির অনুসরণ কর, তবে ঈমানের পর তোমাদের পূণরায় কুফরিতে ফিরিয়ে দিবে”। (আলে ইমরান : ১০০) অন্যত্র : “হিংসার কারণে অনেক আহলে কিতাব চায় ঈমানের পর তোমাদের কুফরিতে ফিরিয়ে দিতে”। ( সূরা বাকারা : ১০৯)
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এহেন সতর্কবার্তাকে অনেক গুরুত্বারোপ করেন, যাতে মুসলমানরা তাদের ফাঁদে না পড়ে। জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত : ওমর (রাযি.) আহলে কিতাবদের থেকে পাওয়া কোন এক কাগজ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পাঠ করলেন। তখন তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন : তোমরা কি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছো যেরূপ বিভ্রান্ত হয়েছিল ইয়াহুদী-নাসারারা। আল্লাহ্র কসম! আমি তোমাদের কাছে একটি অতি উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ দ্বীন নিয়ে এসেছি। মূসা (আঃ)-ও যদি আজ দুনিয়ায় বেঁচে থাকতেন, আমার অনুসরণ ব্যতীত তাঁর পক্ষেও অন্য কোন উপায় ছিল না। (আহমাদ ১৪৭৩৬)
ইমাম শা’বী (রা.) জাবির (রাযি.) মাধ্যমে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন : তোমরা আহলে কিতাবদের কিছু জিজ্ঞেস করোনা। কেননা তারা পথচ্যুত, তাই তোমাদের হেদায়াতের ঠিকাদারি তাদের নেই। আর তাদের দেয়া সংবাদের ক্ষেত্রে হয়তো সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে অথবা মিথ্যাকে সত্য বলবে।
এটা ইসলামের অন্যতম খুঁটি, যার ভিত্তি কুরআনে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে আরো জোরদার করে আমাদের ইবরত গ্রহণের সুযোগসাধ্য করেছেন।