মালেক বিন নবী বিশ অন্যতম মুসলিম চিন্তক, ইসলামী চেতনার বাতিঘর, সভ্যতার সংকট ও উত্তরণ নিয়ে ভেবেছেন, অন্যকে উৎসাহিত করেছেন। যারা তার গ্রন্থাদিতে নযর দিবেন, দেখবেন যে, তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এক, সেটা হচ্ছে সভ্যতার সংকট। তার মতে সভ্যতা এক পরিবৃত্ত, যেখানে সামাজিক সবকিছুর সমন্বয়। কখনো সেটা রাজনৈতিক, কখনো-বা অর্থনৈতিক, কখনো সাংস্কৃতিক বা চারিত্রিক। তাই তার মতে সকল সমস্যার মূল সভ্যতা কেন্দ্রিক। কেউ যদি জাতিগত সমস্যা উপলব্ধি করতে চায়, তবে তাকে মানবসম্পৃক্ত সমষ্টিক পর্যায়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। বুঝতে হবে, কোনটি সভ্যতার উত্থান বা পতনের কারণ। মালিক বিন নবী ছিলেন অভূতপূর্ব চিন্তাবিদ, সভ্যতার বিনির্মাণে তার দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ ও প্রাসঙ্গিক। তার চিন্তাবৃত্তির মধ্যমণিতে বিরাজ বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনা, এবং ইসলামী মননে তাকে প্রতিষ্ঠিতকরণ। ইসলামী চিন্তার বিনির্মাণে এবং সভ্যতাসম্পৃক্ত সমস্যা সমাধানের পথ তৈরিতে তার রচিত গ্রন্থগুলো বিষয়বস্তু ও কাঠামোগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
মালেক তার সংশোধনমূলক কাজের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সভ্যতার নানা অসংগতির দিক তুলে আনেন। কতিপয় ক্ষেত্রে ইতিবাচকতা নিয়েও আলোচনা করেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিভিন্ন বাস্তবিকতা সামনে তুলে আনেন। তার মতে বর্তমান সভ্যতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাদের নিজস্ব অবস্থানের আন্তর্জাতিকীকরণ, বিশ্বে সামগ্রিকভাবে কর্তৃত্বায়ন। এছাড়াও তাদের বাস্তুবাদী প্রবণতা, যা তাদের বৈশ্বিক ও ঐতিহাসিক পরিমণ্ডল নির্ধারণ করে এবং সামাজিক পর্যায়ে তাদের প্রাযুক্তিক আবিষ্কার।
এখানে এসে মালেক নিজের লেখালেখির তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল সাজান : পাশ্চাত্য সভ্যতার গভীরতর ভিত্তি, ফলশ্রুতিগত দিক, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থানের ইতিবাচকতা বা নেতিবাচতকা, মানব ঐতিহ্যের খাতায় তাদের বিভিন্ন আবিষ্কার এবং তাদের কারণে বৈশ্বিক গোলযোগময় পরিস্থিতি। তার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু দু’টি : প্রথমত, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বৈপ্লবিক সঞ্চালনের মূল কী এবং সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তার অভাবনীয় ফলশ্রুতি। এ শেষ কেন্দ্রবিন্দুতে এসে তাদের বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদ, তাদের প্রাযুক্তিক আবিষ্কারের সর্বময় প্রচলন এবং অন্তত শেষ দু’শতকে মানবিক অবস্থানের দিকটি আলোচনায় অনেন।
যদিও তিনি পাশ্চাত্যের সমালোচনা করেন, তবে সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখেন। তার মতে পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানুষ স্বপ্নসিদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন সংকটেও জড়িয়ে পড়ছে। এমনভাবে যে, তারা উভয় ক্ষেত্রেই সম্পৃক্ত ও সমন্বিত। পশ্চিমা আগ্রাসনবাদ বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তারা এর মাধ্যমে সকলকে তাদের নিজস্ব ভাবণায় জড়িয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে মালেক বিন নবির মতামত : ইউরোপ বা পাশ্চাত্য সভ্যতা যদিও বৈশ্বিকভাবে তাদের সাংস্কৃতিক প্রচারণা চায়নি, কিন্তু তারা নিজেরা বস্তবাদী হওয়ার কারণে এবং সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বস্তুবাদ অবলম্বনের কারণে তার প্রচার-প্রসার হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার কারণে বস্তুবৃত্তির প্রভাব প্রাযুক্তিক আবিস্কারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মানুষের আধ্যাত্মিকতাকে ছাড়িয়ে যায়।
মালেকের মতে পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নয়নের মূল কারণ তাদের কর্মবৃত্তিক ব্যাপকতা এবং চিন্তাবৃত্তিক সক্রিয়তা। তবে এ দুই কার্যকারণের মধ্য পারস্পরিক পর্যায়ে দুরত্ব থাকে। বিজ্ঞান তাদের উন্নয়নের পথে নিয়ে যায়, কিন্তু তাদের চিন্তাবৃত্তি সে উন্নয়ন থেকে বিদূরিত। যার কারণে তারা বৈশ্বিকভাবে নিজেদের কর্তৃত্বস্থাপনের ক্ষেত্রে তারা মেরুকরণবাদী হয়, যা “অন্যে”র সামনে “আমি”র অবস্থানকে সমুন্নত করে। যদি এ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তাদের বস্তুবৃত্তিক উন্নতি থেকে মুক্ত করতে হয়, তবে মালেকের মতে মনুষ্য পরিমণ্ডল তার প্রকৃতিকে অস্বীকার করবে। কেননা এতে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মবাদের সংঘাত। কর্মবৃত্তিক পরিসরে যদিও তা শৈল্পিক ও প্রাযুক্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, যদিও তাতে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে, তবে তারা যেহেতু কর্তৃত্ববাদী মনোবৃত্তিসম্পন্ন, তাদের এ মনোভাব পোষণ “অন্য”কে মানুষের গণ্ডি থেকে বহির্ভূত করে। তাদের প্রান্তিক মনে করে। তাদের প্রতি কর্তৃত্ববাদের লিপ্সাকে প্রবৃদ্ধি করে। মালেক উপনিবেশিক রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা সন্তান। তার মতে উপনিবেশবাদ তাদের এ মানসিকতা লালনের কারণ এবং একইসাথে ফলশ্রুতি বহন করে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে রাখি, পাশ্চাত্য সভ্যতা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মালেক “সভ্যতার পুণরাবৃত্তি” মূল মানদণ্ডে রাখেন। আমরা বিস্তৃত পরিসরে এ আলোচনা করবো। তিনি এসব সমালোচনা করতঃ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অলোচনা করেন এবং তার সাথে পাশ্চাত্য সম্পর্কের ধরণকে বিশ্লষণ করেন। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার দুর্বলতম দিকগুলো পাশ্চত্যবাদের মাধ্যমে অলোচনায় আনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তার মতে আন্তর্জাতিকীকরণে পশ্চিমা প্রভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী যে গোলযোগময় পরিস্থিতি, তাকে বিশ্লষণ করে মানব-সমস্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা, সাথে ইসলামী সমস্যার সাথেও তাকে যোগ করতে হবে। এর মাধ্যমে ইসলামী বিশ্ব পাশ্চাত্যের তাবেদার হবেনা, রবং তাদের অভিজ্ঞতাবাদকে নিরীক্ষা করে যথোপযুক্তার বিচারে তাকে গ্রহণ বা বর্জনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ আপেক্ষিকতার মাধ্যমে আমরা তাদের ক্রুটিযুক্ত পন্থা সম্পর্কে যেরূপ অবহিত হবো, ভালো দিকগুলো ইসলামী সামাজিকীকরণে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের স্বার্থ লুফে নিবো।
মালেক শুধুমাত্র বাহিরের পর্যবেক্ষণে পাশ্চাত্যের সমালোচনা করেননি, তিনি দীর্ঘজীবন প্যারিসে ছিলেন। সেখানে তার পড়াশোনা ও বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রায়ণ, খুব কাছ থেকে পশ্চিমা জীবনবৃত্তির গভীরতর পর্যবেক্ষণ করেন। তার কাছে পাশ্চাত্য এক অভিজ্ঞতার মানদণ্ড, জাতিগত অবস্থান ও সভ্যতার পর্যায়ক্রম উপলব্ধির অনন্য এক পরিমণ্ডল, যার যুগপৎ বিবেচনায় আধুনিক ইসলামী চিন্তাবৃত্তির উৎসারণ হবে। তাই তিনি গভীরতরভাবে পাশ্চাত্য উপলব্ধির আহ্বান করেন। পাশ্চাত্য সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি যেন এলোপাতাড়ি হয়। আমরা যাতে তার স্বাতন্ত্রমণ্ডিত দিকগুলো নির্দিষ্ট করি, ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মাঝে পার্থক্য করি, এ দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।