মিসর দীর্ঘ সময় ধরে সভ্যতার উৎসস্থল, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির বাতিঘর। কেনই বা হবেনা, অথচ শেষ এক শতাব্দীতেও যদি আমরা লক্ষ্য করি, তবে দেখব যে, সেখান থেকেই উৎসারিত হয়েছে বড় বড় প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ, যারা নিজেদের জ্ঞান-তত্ত্বের মাধ্যমে আলোকায়িত করেন পথ, সভ্য পৃথিবীতে নিজেদের ও দেশের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন সম্মানের উঁচু আসন… এখন আমরা সেরূপ একজন মহান ব্যক্তির জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো।
তিনি হচ্ছেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, বিশ শতকের অন্যতম ভৌগলিক ও কৌশলবিদ জামাল হামাদান (৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯২৮ – ১৭ এপ্রিল, ১৯৯৩)। কয়েকদিন আগে তার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। ভূগোলশাস্ত্র ও জাতিতত্ত্বে তাঁর যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে রচিত গ্রন্থে তার উদ্ধৃতি থাকতো। এছাড়া নিজের রচিত গ্রন্থের অনুবাদ হয় আন্তর্জাতিক সকল ভাষায়।
আমরা প্রথমে তার কর্মবৃত্তিক জীবন নিয়ে আলোচনা করবো। দ্বিতীয় পর্যায়ে তার চিন্তাবৃত্তিক অবস্থান ও মতামত পর্যালোচনা হবে। এর পাশাপাশি আরো নানা অনুষঙ্গ উঠে আসবে এ সীমিত পরিসরে।
জীবন ও কর্ম :
তাঁর পুরো নাম জামাল মাহমুদ সালেহ হামাদান, মিসরের কালয়ুবিয়্যাহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বংশগতভাবে তিনি ছিলেন আরবের হামাদান গোত্রীয়, যারা ইসলামের বিজয়কালে মিসরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তার পিতা আযহারে পড়ুয়া, পেশাগতভাবে শিক্ষক। পিতার কাছেই প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন এবং পরবর্তীতে পিতার তত্ত্ববধানে কুরআনুল কারীম হিফজ করেন। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি তাওফিকিয়্যাহ স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এরপর তিনি কায়রো ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের ভূগোল বিভাগে ভর্তি হন। পড়াশোনাকালীন সময় থেকেই তিনি অত্যাধিক মনোযোগী ছিলেন।
১৯৪৮ সালে তিনি তিনি ডিগ্রিলাভ করে সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে তিনি অনুষদের পক্ষ থেকে ব্রিটেনে প্রেরিত হন। ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ডের রিডান্জ ইউনিভর্সিটি থেকে ভূগোলতত্ত্বের উপর ডক্টরেট লাভ করেন।
সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের কায়রো ইউনিভার্সিটির কলা আনুষদের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে সহযোগী প্রভাষক পদে উন্নীত হন। তৎকালীন সময় থেকেই নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনায় হাত দেন। ১৯৫৯ সালে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রচনার পুরস্কার পান।
পরবর্তী সময়ে কিছুদিন শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত থাকেন। কিন্তু নিজের সমসাময়িকদের প্রতিহিংসার শিকার হন। তাদের উপর কুম্ভেলিকতার অপবাদ দেয়া হয়। তার মার্যাদাগত অবস্থান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এ সব দেখে তিনি মানসিকভাবে পর্যদুস্ত হন। কর্মধারায় পরিবর্তন আনেন। ১৯৬৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি নেন। একাকিত্বের পথ বেছে নেন। মিসরের : “জিসা” জেলার “দুক্বা” অঞ্চলে স্থায়ীভাবে অবস্থান গেড়ে নেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহ করেননি। এখানে থেকে নিজের জীবনের সেরা সেরা গ্রন্থগুলো লিখেন।
এ সময়ে মিসর ও মিসরের বাহিরে বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়, কিন্তু তিনি একাকীত্ব ও ব্যক্তিগত গবেষণা-অধ্যয়নের কারণে সে সব পদ প্রত্যাহার করেন। সে সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো হচ্ছে :
- ১৯৮৩ সালে জাতিমংঘে মিসরের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ
- কায়রোতে আরবী ভাষা একাডেমির সদস্য পদ গ্রহণ
- কুয়েত ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ
- সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ইরাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ
এছাড়া তিনি দেশীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
গ্রন্থ রচনা :
জামাল হামাদান ছোট-বড় মোট ৩৯ গ্রন্থ এবং ৭৯টি প্রবন্ধ লিখেন। তন্মধ্যে তার রচিত আরবী গ্রন্থগুলো হচ্ছে :
- دراسات في العالم العربي، القاهرة، 1958
- أنماط من البيئات، القاهرة، 1958
- دراسة في جغرافيا المدن، القاهرة، 1958
- المدينة العربية، القاهرة، 1964
- بترول العرب، القاهرة، 1964
- الاستعمار والتحرير في العالم العربي، القاهرة، 1964
- اليهود أنثروبولوجيا، كتاب الهلال، 1967
- شخصية مصر، كتاب الهلال، 1967
- استراتيجية اللاستعمار والتحرير، القاهرة، 1968
- مقدمة كتاب القاهرة لديزموند ستيوارت، ترجمة يحيى حقي، 1969
- العالم الإسلامي المعاصر، القاهرة 1971
- بين أوروبا وآسيا، دراسة في النظائر الجغرافية، القاهرة، 1972
- الجمهورية العربية اللليبية، دراسة في الجغرافيا السياسية، القاهرة، 1973
- 6 أكتوبر في الاستراتيجية العالمية، القاهرة، 1974
- قناة السويس، القاهرة، 1975
- أفريقيا الجديدة، القاهرة، 1975
- موسوعة شخصية مصر: دراسة في عبقرية المكان 4 أجزاء، القاهرة، 1975 – 1984
তার রচিত ইংরেজী গ্রন্থসমূহ হচ্ছে :
- Population of the Nile Mid – Delta, past and present, Reading University, June 1953
- Khartum : study of a city, Geog. Review, 1956
- Studies in Egyptian Urbanism, Cairo, 1960
- Evolution of irrigation agriculture in Egypt, in : A history of land use arid regions, ed. L. Dublet Stamp, Unesco, Paris, 1961
- Egypt, the land and the people, in: Guide book to geology, 1962
- Pattern of medival urbanism in arab world, Geog. Review, April 1962
- Political map of the new Africa, Geog. Review, October 1963
- The four dimensions of Egypt.
মৃত্যু :
তিনি কিভাবে মৃত্যুবরণ করেন, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তবে তার মৃতদেহের নিম্ন অর্ধেকাংশ দগ্ধ ছিল। তাই সবার ধারণা দগ্ধ হওয়াই তার মৃত্যুর কারণ। কিছু জিসা অঞ্চলের স্বাস্থকর্মী ড. ইউছুফ জুনদির রিপোর্ট মতে, মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি গ্যাস দ্বারা শ্বাসরুদ্ধ হননি, তদ্রুপ দগ্ধতা এমন ছিলনা যে, তা মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
তার নিকটবর্তী লোকেদের দাবী মতে, তিনি যে স্থানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখান থেকে তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায়। সে সব পাণ্ডুলিপির ভিতরে ইহুদিবাদ ও জায়নবাদ নিয়ে হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী একটি গ্রন্থ ছিল। আগুন জামাল হামাদানের বইয়ের তাক পর্যন্ত পৌছেনি। যার কারণে বলা যায় যে, অন্য কেউ এখান থেকে এ পাণ্ডুলিপি সরিয়েছে। তার ভাই আব্দুল আজীম হামাদান বলেন যে, যে পাকশি তার খাবার-দাবার রান্না করতো, সহসা একদিন সে পা ভাঙ্গার অযুহাতে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তার বাড়ি কোথায়, এটা সঠিকভাবে কেউ জানতো না। তার অন্য এক প্রতিবেশি বলেন : জামাল ফ্ল্যাটের যে তলায় থাকতেন, তার উপর তলায় মৃত্যুর আড়াই মাস আগ থেকে দরবেশ প্রকৃতির এক পুরুষ ও নারী বসবাস করতো, তার মৃত্যুর পর থেকে তারা উধাও হয়ে যায়। ইনটেলিজেন্স বিভাগের সাবেক প্রধান আমিন হুয়াইদি তার মৃত্যুর ব্যাপারে এমনসব নথিপত্র পান, যার দ্বারা সাব্যস্ত করেন যে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তার হত্যার সাথে জড়িত।
চিন্তা ও ভাবনা
ভূ-তত্ত্ব ও ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব :
জামাল হামাদান নিজের জীবদ্দশায় ততটা কদর পেয়ে যাননি। পরবর্তীতে চিন্তকরা লেখালেখি থেকে তার ভূগোল তত্ত্বের নানা প্রতিভাসম্পন্ন দিক আবিষ্কার করেন। কিন্তু এখানেও এসে তারা একটি দিককে এড়িয়ে যান, সেটা তার কৌশলী চিন্তা-ভাবনা। এমনকি তার মতে ভূগোল বিদ্যা হচ্ছে : প্রত্যেক মানবসমেত ভৌগলিক অঞ্চলের সামগ্রিক উপাদানের প্রতি কৌশলী দৃষ্টি প্রদান এবং তাদের উন্নয়ন-পতনের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ। তিনি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শুধু তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট বা আংশিক বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন না, বরং তাকে ব্যাপকতর ও ভবিষ্যতদর্শী দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করেন।
জামাল হামাদান ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও অনন্য। তিনি তাকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণে দেখেন। তার মতে ভূ-রাজনীতি ভূমি ও তার বস্তুবৃত্তিক নানা দর্শনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কৌশলবিদ্যার সাথে তার সম্পর্ক সার্বজনীন এবং জাতির সাংস্কৃতিক ও নাগরিক পরিচিতির সাথেও তার সম্পৃক্ততা আছে অটুট। তাই তিনি ভূগোলের বাহ্যিক বিষয়গুলোর ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রেক্ষাপটভেদে স্থায়ী ফলশ্রুতি আবিস্কার করেন। তাই তার ভৌগলিক তত্ত্ব প্রাকৃতিক উপাদান-উপকরণে সীমাবদ্ধ থাকেনা, বরং তিনি নিজের দীপ্ত বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে জাতির ঐতিহাসিক ভিত্তি ও নাগরিক অবস্থান নিরূপণ করেন। যাতে তার ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব স্বতন্ত্র পরিমণ্ডলের রূপ পরিগ্রহ করে। তাই তার সম্পর্কে মিসরীয় চিন্তাবিদ আব্দুর রউফ আবু সা’দের এ মতামতে কোন অত্যুক্তি নেই যে, জামাল হামাদানের চিন্তাবৃত্তি ভূ-তত্ত্ব, ইতিহাস ও মানবকর্ম পর্যবেক্ষণ দ্বারা সমন্বিত। তার মতে ভূগোল হচ্ছে শাস্ত্রীয় বিভিন্ন জ্ঞান সমন্বয় করার স্থান, তাই তাতে ভূ-তত্ত্ব, রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের সমন্বয় রয়েছে। ভূগোলের ক্ষেত্রে এ যৌগিক মনন তার অনমনীয় গঠনতত্ত্বের প্রাতিস্বিকতা বহন করে, যেখানে তার কাছে জ্ঞান-তত্ত্বের স্বরূপ হচ্ছে, গতানুগতিকভাবে তথ্যের উপস্থাপন, থিউরি সাব্যস্তকরণ বা বাস্তবতার বিশ্লেষণ নয়, বরং একটাকে আরেকটার সাথে সমন্বয়জাত করে গঠনতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করার নামই জ্ঞান।
জায়নবাদী মিথ্যাচরের অপসারণ :
বর্তমান ইহুদিদের মিথ্যাচার অপসারণের ক্ষেত্রে জামান হামাদানের অবস্থান অগ্রগণ্য। তিনি তাদের বনী ইসরায়েল হওযার দিকটি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেন, যারা ঈসা (আ.) এর জন্মের আগে ফিলিস্তিন ত্যাগ করেছিল। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এনথ্রপলজি অব জিউস গ্রন্থে নৃতাত্ত্বিক প্রমাণাদির সাব্যস্ত করেন যে, বর্তমান ইহুদি, যারা ফিলিস্তিনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবী করতঃ খ্রিষ্টপূর্বে নির্বাসিত ইহুদিদের বংশধর হওয়ার দাবি করে, তারা নিজস্ব দাবির ক্ষেত্রে সঠিক নয়। বরং বর্তমান ইহুদিরা তাতার বংশীয় খাজারী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত, অষ্টম শতকে যারা ক্যাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি অঞ্চলে বাস করতো। তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি অর্জনের জন্য ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে। জামাল হামাদানের এ মতামতকে আর্থার কোষ্টলার “দ্যা থার্টিনথ ট্রাইব” গ্রন্থে আরো জোরালে করেন।
জামাল হামাদান সে মুসলিম চিন্তকদের একজন, যারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহের খিদমাহ করে গেছেন। বিশেষভাবে তার সুতাত্ত্বিক ও কৌশলবাদী দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখল করার অবৈধ ভিত্তিকে বিধ্বংস করেন।
প্রখ্যাত মিসরীয় গবেষক আব্দুল ওয়াহহাব মাসিরী তার সুবিস্তৃত মহান কর্মের মাধ্যমে জায়োনিষ্টদের চিন্তাবৃত্তিক ভিত্তি বিযুক্ত করেছেন। কিন্তু জামাল হামাদান তারচেয়ে আরো আগে বেড়ে তাদের নৃতাত্ত্বিক দাবির অসারতা সাব্যস্ত করেন। তিনি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠাকে সাম্রাজ্যবাদী কর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা কতিপয় লোক দ্বারা জবরদখলকৃত, যাদের এ ভূমির সাথে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক বা জাতিগত সম্পৃক্ততা নেই। তার মতে ইহুদি কালভেদে দু’ধরণের : প্রাচীন ও আধুনিক। তাদের মাঝে কোন নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক নেই। কেননা তাওরাতে বর্ণিত ফিলিস্তিনি ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর দু’হাজার বছরের ডায়াসপোরিক জীবনে দু’টি বাস্তবতার সম্মুখীন হয় : তাদের অনেকে ভিন্ন ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় বা ভিন্ন ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে। এরপর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জাতিগত সংমিশ্রণ হয়, যাতে তাদের আর বংশীয় খাঁটিত্ব বহাল থাকেনা। এখন তারা নৃতাত্ত্বিকভাবে হয়ে ওঠে ভিন্নজাতের , যাদের তাওরাতী ইহুদিদের সাথে আর কোন সম্পৃক্ততা থাকেনা। এখন ফিলিস্তিনকে প্রতিশ্রুত ভূমি দাবি করে জবরদখল করার যুক্তি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
যে সময়ে জায়োনিষ্টরা বিভিন্ন আরব্য ইসলামিক রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের খোড়ল তৈরির জন্য ডেমোক্রটিক ইহুদি রাষ্ট্রের ভিত্তি ঘোষণা করে, তখন তাদের এ খোলস জামালকে বিভ্রান্ত করেনি, তিনি নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে তাদের বিভ্রান্তির মুখোশ উন্নোচন করেন : সুস্থ-সঠিক রাজনৈতিক রুচিবোধে কখনো ইহুদি জাতিয়তাবাদের দিকটি সুপ্রতিপন্ন হবে না, কেননা তারা যে কোন দিক থেকে সুনির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী নয়। বরং নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় তাদের মাঝে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মিশ্রণ থাকার কারণে তাদের একেকজন ভিন্ন ভিন্ন জাতি-উপকরণ ধারণের এক সমন্বিত জাদুঘর। তাই নিজেদের কল্পিত জাতি-খাঁটিত্বকে মনেপ্রাণে ধরে ইসরায়েলের মতো কৃত্রিম রাষ্ট্রের তৈরি তাদের বর্ণবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আরয়েল শরোন ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে ইজরায়েলকে ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণার দাবি তুলে এবং তার দাবিকে আরো সরগরম করে প্রসিডেন্ট জর্জ বুশ। জামাল হামাদান তাদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে কলম ধরেছেন বহু আগে। ১৯৬৮ সালে তার استراتيجية اللاستعمار والتحرير গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। তিনি তাতে বলেন : ইসরায়েল ইহুদি কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তাদের লক্ষ্য ইহুদিদের এক রাষ্ট্রে সমন্বিতকরণ। তাই ধর্মীয় গোঁড়ামি হবে তাদের অনন্য অবলম্বন। কিন্তু সাম্পদায়িকতা কেন্দ্রিক তাদের রাজনৈতিক দর্শনকে পশ্চাদগামিতা ও প্রান্তিকতার এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে যে, তাদের জীবনবৃত্তি হবে মধ্যযুগীয় বর্বরতার, বরং পাথুরে যুগের সহিংসতার…
ইসরায়েল সম্পৃক্ত গবেষণার গভীরতায় জামাল হামাদান বুঝেছিলেন যে, “শান্তি” নামক জিনিষটি ইসরায়েলের কুড়িয়ে পাওয়া অস্তিস্ত্বের জন্য না পাওয়া বস্তুই থেকে যাবে। তাদের অস্তিস্ত্ব টিকে থাকবে রক্তপাত, গোলাবর্ষণ আর লৌহদণ্ডের মাধ্যমে। আর এ কারণে সর্বত্র তাদের সামরীকিকরণ। তাদের সেনাবাহিনী দেশীয় অধিবাসী, আবার অধিবাসীরাই সেনাবাহিনী।
ভবিষ্যতদ্রষ্টা জামাল হামাদান
হ্যাঁ, জামাল হামাদান ভবিষ্যতদ্রষ্টা। তবে এর জন্য তাকে অলৌকিক বা অধিবিদ্যক শক্তিধর বলার কোন যৌক্তিকতা নেই। তবে তিনি ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সমকালীন প্রেক্ষাপটকে খুব যুগপৎভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন। তাই এসবের মাধ্যমে ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা অসম্ভব কিছু না। ষাটের দশকে সোভিয়েত তাদের সম্মানসূচক অবস্থানের সর্বোচ্চে ছিল। উত্তরে-দক্ষিণে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ঝড় বইছিল। কিন্তু জামাল হামাদান ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ তে “استراتيجية اللاستعمار والتحرير”সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিয়ে বলেছিলেন। এর প্রায় একুশ বছর পর ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ ইউরোপীয় মহলে ভাঙ্গন শুরু হয়। সেখানে পূর্ব ইউরোপীয় কর্তৃত্ব ম্লান হয়ে যায়। ইউরোপীয় দেশগুলো সোভিয়েত কর্তৃত্বের হাতছাড়া হয়। ভাঙ্গনে-ভাঙ্গনে এক পর্যায়ে ১৯৯১ সালে তাদের পতন হয়।
জামাল হামাদানের বিভিন্ন বই পড়ে ভবিষ্যত-দর্শনের আরো কতিপয় নজির পাওয়া যায়। ২০০৩ সালের ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রোকসিলে ইউরোপীয় সামরিক বাহিনী গঠিত হয়, যা ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চলিক চুক্তির ধারা বহির্ভূত এবং পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে মৈত্রিচুক্তি বিনষ্টের ঐতিহাসিক সময়। আমরা দেখি যে, জামাল হামাদান এ ব্যাপারে আরো পনের বছর আগে আলোকপাত করে যান “جمال حمدان.. صفحات من أوراقه الخاصة” গ্রন্থে। তিনি বলেন : “সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন শত্রুর অনুসন্ধান শুরু হবে। কেউ বলে শত্রু হবে “ইসলাম”। আমরা দৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করি, ইসলাম এ শত্রুতার আওতা বহির্ভূত। ইসলাম তো শুধু সময়ের বলি। প্রকৃত শত্রু হচ্ছে পাশ্চাত্যের বিজয়ী শক্তি। অচিরেই আমেরিকার সাথে পশ্চিম ইউরোপ বা জাপানের তীব্র সংঘর্ষ হবে”। অন্যত্র তিনি বলেন : ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রতিপক্ষ ইউরোপ ও আমেরিকা। স্নায়ুযুদ্ধ প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য বা সাম্যবাদ থেকে পুঁজিবাদে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন এ যুদ্ধ পাশ্চাত্যের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, পূর্ববর্তী পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যে; যেখানে একদিক ফ্রান্স ও জার্মানি এবং অন্যদিকে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা পরস্পরের প্রতিপক্ষ।
জামাল হামাদানের ভবিষ্যত-দর্শন ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হতে থাকে আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তিনি ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে বড় বড় পরাশক্তির জোটবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও আলোকপাত করেন। তিনি বলেন : কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইসলামী বিশ্ব ও ইসলাম পাশ্চাত্যের নতুন শত্রু হিসেবে অবির্ভূত হবে। এটা নতুন কিছু না। নতুন হচ্ছে, পাশ্চাত্য কমিউনিজমকেও নিজেদের বিরোধিতার কাতারে নিয়ে আসবে শক্তির সমন্বয়ের জন্য। যাতে সকলে ইসলামের বিরুদ্ধে সমন্বিত হতে পারে। এটাই বাস্তব হয়েছিল। এমনকি স্যামুয়েল হান্টিংটন এ মৈত্রিত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক বর্ণনা দিয়েছেন “ক্লেশ অব সিভিলাইজেশন” গ্রন্থে। তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ নিউকনজার্ভেটিভরা “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে”র স্লোগান দিয়ে। বাস্তবিকপক্ষে এটা ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী যুদ্ধ।
জামাল হামাদান আমেরিকা পতন নিয়েও ভবিষ্যত বাণী করেন, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। তিনি নব্বই দশকের শুরুতে লিখেন : “আমার সামনে এটা সুস্পষ্ঠ হয় যে, আমেরিকা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপক্ষ হয়ে প্রকাশ্যে সহিংসতার রেষ ছড়াচ্ছে। তাদের প্রতি সকলের ক্রোধের বিষয়টিও অস্পষ্ঠ নয়। আজ বিশ্ব চরম ধৈর্যের পথ অবলম্বন করে তাদের পতনের প্রত্যাশায় মুখিয়ে আছে। পতনের সময় আমেরিকা স্বরূপ অক্ষম-পরাহুত প্রাণীর মতোই হবে”। “সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার সামরিক বিজয় আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। নিজেদের শক্তিময় অবস্থানের কারণে তারা রাজনৈতিক উন্মত্ততায় ডুবে আছে। পরিশেষে এ উন্মত্ততাই তাদের পতনের কারণ হবে”।
জামাল হামাদান প্রত্যক্ষ করেন যে “আমেরিকা চলমান সময়ে নিজের শক্তিমত্তা বজায়ে মত্ত। কিন্তু তাদের অবক্ষয় স্বতস্বিদ্ধ সত্য। তাদের সাথে নব্য প্রতিযোগীদের – ইউরোপ, জার্মানী, জাপান – সাথে তাদের যে কোন মুহুর্তে সংঘর্ষ বাধতে পারে। কৌশলগত দিক থেকে জাপান ও জার্মানিকে আমেরিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তাছাড়া তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। আমেরিকার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতির দিকটি নিম্নগামী। কেননা, ইউরোপের অর্থনৈতিক মুদ্রা সীমিত সময়ের ভিতরে আমেরিকান ডলারকে ছাড়িয়ে যায়”।
জামাল হামাদানের লেখায় ভবিষ্যতে ইসলামের পূণরুত্থানের দিকটিও ধরা পড়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যতিক্রমধর্মী একটি দিক আমাদের সামনে তুলে ধরেন : “ইসলামের গতিশীলতা ভিন্ন। আগে উত্তর ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামের প্রচার-প্রসারে কমতি ছিল, এখন তা ক্রমহারে বাড়ছে। এছাড়া মধ্য ইউরোপেও মুসলমানদের অভিবাসন হচ্ছে”। এর মাধ্যমে ভিন্ন ও নতুন স্থানে ইসলামী বিপ্লবের আশাবাদও ব্যক্ত করেন।
পরিশেষে জামাল হামাদানের ভূ-তত্ত্ব নিয়ে আবারো বলছি, যেখানে তিনি নিজের সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন, প্রাতিস্বিক দৃষ্টিকোণে তার স্বতন্ত্র পরিমণ্ডল দাড় করিয়েছেন। তার সাথে সমন্বয় করেছেন ইতিহাস-অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান। এভাবে বহুমাত্রিক পরিমণ্ডলে দাড় করিয়ে তাকে আমাদের জীবনবৃত্তির সাথে একান্ত ঘনিষ্ঠ করেছেন। তারই ভাষায় শুনি ভূগোল বিদ্যার সংজ্ঞা : তা বিষয়বস্তুর দিক থেকে শাস্ত্র, বিবেচনার দিক থেকে শিল্প, চিন্তাগত দিক থেকে দর্শন… এ ত্রিত্ববাদী ধারণার মাধ্যমে তিনি ভূগোলকে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়ে যান চিন্তাগত দর্শনে, ভূ-কেন্দ্রিক বাস্তবতা থেকে নিয়ে যান সুউচ্চ চিন্তাবৃত্তিক অবকাঠামোতে।
এসবের পরেও আফসোস, জামাল হামাদান যথাযথ কদর পাননি। একাকীত্বের জীবনে হারিয়ে যান, কিন্তু সেখান থেকে কুড়িয়ে আনেন নিজের স্বতন্ত্র চিন্তাবৃত্তি। যখন তিনি করুনভাবে মৃত্যু বরণ করেন, তখন তার চিন্তাবৃত্তিক গভীরতা নিয়ে কথা ওঠে একাডেমিক মহলে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রহম করুন।