মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্বস ও ওলামায়ে কেরামের সঠিক অবস্থান

ইসলাম তার ইতিহাসের প্রত্যেক ধাপেই বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়, যা মুসলমানদের ঈমানের মৌলিকত্ব, স্বকীয় মূল্যবোধ ও নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিসর থেকে বের করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। যুগ-পরিবর্তনের ধারাপাতে সে মাধ্যম ও উপকরণ বিভিন্ন হলেও মৌলিক উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সকলের গন্তব্য একই— মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রণোদনা দান, ধারাবাহিক সংঘর্ষ, অভ্যন্তরীণ ভাবে বিভিন্ন গোলযোগ পাকিয়ে তাদের সম্মুখের পথ কণ্টকাকীর্ণ করা, সাধারণ জীবনযাত্রায় তাদের উদ্ধিগ্ন ও উৎকন্ঠিত করার চেষ্টা, যাতে তারা প্রশান্তির শ্বাস না নিতে পারে।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই বাস্তবতাই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে বার বার। কুরআনুল কারিম আমাদের এর জন্য যুগপৎ অবস্থানের কথা বাতলে দিয়েছেন। এ ঝুঁকির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সদা সর্বদা প্রস্তুতিমূলক অবস্থানে থেকে সর্বাত্মক প্রতিরোধের উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুত রাখ শক্তি… যা দিয়ে তোমরা ভীত-সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহ্‌র শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে…” আরো বলেছেন, “তোমরা ধৈর্য ধারণ কর , ধৈর্যে প্রতিযোগিতা কর এবং সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক…” আমাদের ইঙ্গিতবহ করেছেন যে, শত্রু কিভাবে আমাদের বিরোধিতায় সদা তৎপর থাকে যুগপৎভাবে অক্রমনের সুযোগে…
কুরআনুল কারিম আমাদের সদাপ্রস্তুতির নীতি শিখান। মুসলমানদের তার দিকে আহ্বান করেন। মুসলমানদের আরো অন্যান্য স্বাতন্ত্র্য বজায়ের সাথে সাথে নিজেদের মৌলিকত্ব ও মূল্যবোধ আকড়ে ধরার স্বরূপ তুলে ধরেন, যাতে উম্মতে মোহাম্মদীর পৃথিবী-কর্তৃত্বের দায়িত্বভার ফুটে ওঠে।
কিন্তু মুসলমানরা এ খোদায়ী-নীতি ভূলে যায়। সতর্কতা, সজাগ-সচেনতা ও যুদ্ধ-প্রস্তুতির ময়দান থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেয়। তাই শত্রুরা যুগপৎভাবেই আক্রমণ করে বসে। যদি ইসলাম খোদায়ী ধর্ম না হতো, খোদায়ী সাহায্যের হাত তাতে না থাকত, তবে অনস্তিত্বের পথ ধরত বহু আগেই।
বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ সশস্ত্র যুদ্ধের আগাম পূর্বাভাস ও সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ঈমান, একত্ববাদ ও নৈতিক মূল্যবোধ, প্রতিদান ও আখেরাত-দিবসের বিশ্বাসের পরিবর্তে মুসলমানদের মষ্তিস্কে নাস্তিক্য, নৈরাজ্য ও বস্তুবাদসহ আরো অবক্ষয়বাদী বিভিন্ন মতাদর্শ অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টাই বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের প্রধান কাজ।
পূর্বেকার যুগ থেকেই ইসলাম এসবের পাশ কেটে যাচ্ছে। সমাজ-সংস্কারক ও জাগরূক ব্যক্তিবর্গ এ কাজেই ব্রতী হয়েছেন যে, মুসলমানদের সকল অপশক্তি ও বিজাতীয় সাংস্কৃতির কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করবেন, চাই তা যেরূপই হোক।
ইতিহাস পর্যালোচনায় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয় যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা বস্তুবৃত্তিক উন্নতি সাধনের মাধ্যমেই হবেনা। কেননা প্রত্যেক যুদ্ধের সাথেই চিন্তাবৃত্তির সম্পর্ক থাকে। তাই মুসলমানদের মাঝে চিন্তাবৃত্তিক পুনর্জাগরণই এ থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে মূখ্য হয়ে কাজ করবে।
যুগে যুগে ইসলামী ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সংস্কারক হিসেবে যাঁরাই আবির্ভূত হয়েছেন, তারা সে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, যা ইসলাম তার মানসঃ সন্তানদের অন্তরে সঞ্চার করে। তার প্রবাহধারায় সিক্ত হয় তাদের আত্মা-অনুভুতি। তাই তারা বিশ্বাস করত যে, প্রাথমিক ভাবে চিন্তাবৃত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে মুসলমানদের পরাজয় পরবর্তী সকল পরাজয়ের সূত্র টেনে আনে।
পনের, ষোল ও সতের দশকের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ক্ষেত্রে এ বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্বসই কাজ করেছিল। প্রাচ্যে তাতারী ও ক্রুসেডারদের সাথে পরাজয়ে, পাশ্চাত্যে ইউরোপীয়দের সাথে এ দৃশ্যই আমরা দেখেছি।
এ যুদ্ধের বিস্তারিত অধ্যয়ন আমাদের সামনে এ চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। মুসলমানদের মাঝে যখন শুউ’বিয়্যাহ ও বাতেনিয়্যা আন্দোলনের জোয়ার ওঠে। একত্ববাদ, নৈতিকতার ও আখেরাত-বিশ্বাসের মূল্যবোধের পরিবর্তে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিতে ভর করে গ্রীক, পারস্য ও ভারতের ঘূণে ধরা দর্শন। বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও প্রগতির শিরোনামে বিভিন্ন আন্দোলন। শরিয়তের অনুশাসন পালনে শৈথিল্য দেখা দেয়। এসবের প্রভাবে তাদের থেকে ঈমানের মৌলিকত্ব বিদূরিত হয়। তাদের ইসলামী চেতনার দীপ্তি-ঔজ্জ্বল্য নির্বাপিত হয়। ফলে মুসলমানরা কালের আবর্তে দুর্বিষহ হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ইসলমী চিন্তাবৃত্তির বিভিন্ন অঙ্গনে এসব ভয়াবহ প্রতিরূপ দাড় করায়। কোরআন-হাদিসের নসের অলীক ব্যাখ্যা প্রদান, সন্দেহজনকভাবে ইসলামের বিষয়াবলীর উপস্থাপন, বিভিন্ন অমূলক প্রশ্নের উত্থাপন তাদের মূখ্য কার্যাবলী হয়ে ওঠে।
এসব মতাদর্শের লোকের নিজেদের চিন্তাবৃত্তি ও মূল্যবোধ ধার করে নিত পূর্বের সকল পৌত্তলিক ধর্মসমূহ থেকে। এটাই তাদের অস্তিত্ব-রক্ষার সম্বল হতো। ইসলামী মূল্যবোধের সাথে এসবের সংমিশ্রণ ঘটাতো। ফলে মুসলমানদের অন্তরে সুপ্ত একত্ববাদের মহামূল্যবোধের মাঝে অনুপ্রবেশ হতো সে পৌত্তলিকতার ধারা, যার বিরোধিতায় মহানবী (সা.) জীবন-সংগ্রাম ছিলো। পাশাপাশি সম্পদ ও নারীভোগের অবাধ বৈধতা, ধর্মীয় আবশ্যিক কর্মের গুরুত্বহীনতার ভাবও জাগিয়ে তুলতো তাদের মাঝে। মাহরাম নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বৈধতা ছিল তাদের অন্যতম কার্যাবলীর একটি।
তাদের বিভিন্ন দাবীর মাঝে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ এটা ছিল যে, কোরআনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থ রয়েছে। কোরআনের বাহ্যিক অর্থের সাদৃশ্য বীজের খোসা, আর অভ্যন্তরীণ অর্থের সাদৃশ্য খোসার ভেতরকার অস্থিমজ্জা। এর মাধ্যমে ধর্মীয় পরিভাষা সমূহের মৌলিক অর্থে আড়াল করে ফেলে। ধর্মের বিভিন্ন দায়িত্ববহ কর্মকাণ্ড “বাহ্যিক” বলে চালিয়ে দেয়। যিনি “ইলমে বাতেন” জানেন, তার বাহ্যিক কর্মাদি পালনের প্রয়োজন পড়েনা।
এ সব অলীক-অসত্য মতাদর্শের প্রভাবে মু’তাজিলারা যুক্তিকে সর্বস্ব মনে করে আত্মিকতার উপর — যেখানে উভয়ের সমন্বিত রূপ ইসলাম। তার বিপরীতে বিভিন্ন সুফিবাদী দর্শনে পাইকারী হারে যুক্তির উপর আত্মিকতার প্রাধান্য। এসব প্রান্তিকতার সামীহ স্থান নেই ইসলামে।
নিসন্দেহে বর্তমানে পূর্বের সেসব অবক্ষয়বাদী মতাদর্শের নতুনত্ব হচ্ছে অনেকটা কপি-পেস্টের মতই। তাদের মতিগতিও নতুন কিছু নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের অলীক-অসত্য যুক্তির আদলে এমন হিংসুক শ্রেণির প্রজন্ম তৈরি করবে, যারা মানুষদের তর্কবিতর্ক, ঝগড়াঝাটি ও প্রতারণার জালে ফেলে ইসলাম-ভোলা করবে। বস্তুবাদের ছোঁ দেখিয়ে মতিভ্রম-মতিভ্রষ্ট করবে তাদের।
এসবের মোকাবেলায় সঠিক ইসলামী চেতনার মশালবাহীরা বসে নেই। তাদের ভূমিকা নিশ্চুপতা বা আত্মসমর্পণের নয়। তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন মুক্তমনা দৃষ্টিভঙ্গি ও অবক্ষয়ের স্রোত প্রবাহে মানুষ, হাসান বসরী চেতনা-দীপ্তি ও গাম্ভীর্যপুর্ণ কথামালার ঝংকার নিয়ে মাঠে আসলেন। যখন নাস্তিক্যের ব্যাপক সয়লাব, ইসলামের সঠিক মুল্যবোধ নিয়ে ময়দানে পদার্পণ করলেন আবু হুজাইল আ’ল্লাফ ও ইব্রাহিম নেজাম। যখন পূর্ববর্তী আইম্মাদের অন্ধভক্তির সমীরণ ওঠে, ইবনে হাযাম তাঁর দুর্নিরোধ্য লিখনি নিয়ে হাজির হলেন। খালকে কোরআনের মাসআলায় ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের অবস্থান পাহাড়সম, অপ্রতিরোধ্য। শু’উবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে চলতে থাকে ইমাম জাহেযের অপ্রতিরোধ্য কলমীশক্তি। তাওহিদের সঠিক অর্থ বিনষ্টের পথে যখন, ইমাম আশআ’রী একত্ববাদী চেতনার দীপ্তি নিয়ে অসার প্রমাণ করলেন তাদের ঠুনকো মতবাদ । “তাসাউফে”র মৌলিকার্থ বিকৃতির প্রতিরোধে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার অবদান যথাসামান্য ছিলোনা। এভাবেই যুগে যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্বসের প্রতিরোধ হয়। ইসলমী মতাদর্শ তার স্বমহিমায় অটল-অবিচল থাকে। আল্লাহর বাণীই এ ক্ষেত্রে যথার্থ হয়ে ওঠে, “বরং আমরা সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর; ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়”। (সূরা আম্বিয়া :১৮)

One Reply to “মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্বস ও ওলামায়ে কেরামের সঠিক অবস্থান”

Leave a Reply to Asif Cancel reply