ইসলামের চতুর্থ খলিফা

লেখক: মাওলানা তামিম মুনতাসির

নাম ও বংশ পরিচয়:
নামঃ আলী
উপনামঃ আবু তুরাব, আবুল হাসান
উপাধিঃ মুরতাজা, আসাদুল্লাহ, হায়দার

পিতাঃ আবু তালেব (রাসুলুল্লাহ সা. এর আপন চাচা)
মাতাঃ ফাতেমা বিনতে আসাদুল্লাহ

রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে সম্পর্কঃ
হযরত আলী রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর আপন চাচাতো ভাই ছিলেন।

জন্মঃ
হযরত আলী রা. পবিত্র মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেসময় রাসুলুল্লাহ সা. এর বয়স হয়েছিল ৩০ বসর।

অবয়ব প্রকৃতিঃ
চেহারা ছিল সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল ও অত্যন্ত সুন্দর। কপাল ছিল প্রশস্ত। লম্বা-চওড়া দাঁড়ি ছিল। অধিকাংশ সময় মাথা মুন্ডন করতেন। তার সিনা প্রশস্ত ও মাংসল ছিল। মোটাতাজা ও বড় শরীরের অধিকারী ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণঃ
শিশুদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাঃ সোমবারের দিন নবুয়ত লাভ করেন আর আমি পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারে ইসলাম গ্রহণ করি।সেসময় আমি মাত্র ১০ বছরের বাচ্চা ছিলাম।

হিজরতঃ
হযরত আলী রা. ইসলাম গ্রহণের পর থেকে সবসময় রাসুলুল্লাহ সাঃ এর তালীম-তারবিয়াতে ছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ সা: এর প্রতি কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে যে সমস্ত বিপদ ও কষ্ট আসতো সেগুলোতে তিনিও ভাগীদার ছিলেন। একরাত্রে মক্কার বড় বড় সর্দাররা রাসূলুল্লাহ‌ সা: কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে ফেলে এবং ওত পেতে থাকে। এদিকে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা ওই সমস্ত শত্রুদের উপস্থিতির খবর তাঁর রসূলকে জানিয়ে দেন। অতঃপর তিনি আল্লাহ তা’আলার আদেশে হিজরত করার ইচ্ছা করেন। সেই সময় রাসূলুল্লাহ সাঃ এর কাছে শহরবাসীর অনেক জিনিস আমানত স্বরূপ ছিল। তিনি আলী রা. কে আদেশ দিলেন যে, তুমি আমার বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকো। আর সকাল হওয়া মাত্র এই সমস্ত আমানতকে তার মালিকদের নিকটে পৌঁছে দিও। অতঃপর আমার পরিবারের লোকজন সহ মদিনায় আমার নিকট চলে এসো। এই দুশমনেরা তোমার সামান্য ক্ষতি করতে পারবেনা। এই বলে রাসুলুল্লাহ সাঃ শত্রুদের চোখের সামন দিয়ে বের হয়ে গেলেন। আর তারা টেরও পেল না। তারা এটাই মনে করতে ছিল যে রাসুলুল্লাহ সাঃ এখনও ঘরের ভিতরে নিজ বিছানায় শুয়ে আছেন। সকালবেলা যখন তারা ঘরে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জায়গায় আলী রা. কে দেখতে পেল তখন তারা খুব লজ্জিত হলো। তখন তারা রাসূলুল্লাহ সাঃ এর খোঁজে এদিক-সেদিক বেরিয়ে পরলো। এদিকে আলী রা. রাসূলুল্লাহ এর কথামতো ওই আমানত গুলিকে তার মালিকদের নিকটে পৌঁছে দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাঃ এর পরিবার-পরিজনসহ মদিনায় চলে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সাথে নতুন সম্পর্ক:
হযরত আলী রা. তো একদিকে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। আবার রাসুলুল্লাহ সাঃ তার ছোট ও সবচেয়ে আদুরে কন্যা হযরত ফাতেমা রা. কে ২য় হিজরীর রমজান মাসে আলী রা. এর সাথে বিবাহ দেন এবং জিলহজ মাসে বিদায় করিয়ে দেন। এই সম্পর্কের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাঃ আলী রা. এর শ্বশুর ও আলি রা. রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জামাই হয়ে যান। জান্নাতী নারীদের সর্দারনী হযরত ফাতেমা রা. এর ঔরসে তার তিন পুত্র হযরত হাসান হুসাইন ও মুহসিন (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন ও তিন কন্যা হযরত যয়নব,উম্মে কুলছুম ও রোকেয়া (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন।

বাবুল ইলম (জ্ঞানের দরজা), আসাদুল্লাহ (আল্লাহর বাঘ) ও আবু তুরাব উপাধি হওয়ার কারণঃ
হযরত আলী রা. ইলমে নববীর এক বিশাল ফটক ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেনঃ “আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী হলো সেই শহরের দরজা”। এ কারণেই থাকে “বাবুল ইলম” বলা হয়।
আলী রা. অত্যন্ত বাহাদুর ছিলেন। এ কারণেই তাকে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর বাঘ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। খায়বারের যুদ্ধে খায়বার দুর্গ কেউ বিজয় করতে পারছিল না। কিন্তু তিনি একাই সেই দুর্গের বিশালাকার দরজা উপরে ফেললেন আর মুসলমানদের জন্য সেই দুর্গে প্রবেশের পথ তৈরী করে দিলেন। অথচ ঐ দরজা এই পরিমাণ বাড়ি ছিল যে যুদ্ধের পর ৮/৯ জন যুবক ছেলে ঔ দরজাকে উঠাইতে চাইল কিন্তু তারা সামান্যও নড়াতে পারেনি। অবশেষে ৪০ জন যুবক মিলে ঐ‌ দরজা উঠিয়েছে।

একবার তিনি কোনো এক কারণে হযরত ফাতেমা রা. এর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে মসজিদে নববীতে গিয়ে শুয়ে থাকেন। মেঝে কাঁচা ছিল। এ কারণেই তার শরীরের ঘামে কিছু মাটি তার শরীরে লেগে যায়। কিছুক্ষণ পর যখন রাসুলুল্লাহ সাঃ ঐদিকে আসলেন আর আলী রা.কে শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলেন, তখন তিনি বললেন,” হে আবু তুরাব (মাটি ওয়ালা) ওঠো! এরপর থেকে আলী রা. কে আবু তুরাব নামেও ডাকা হতো। আর তিনিও এই নাম শুনে খুব খুশি হতেন।

খেলাফত:
ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমান গনি রা. এর শাহাদতের পর কিছু সাহাবা ব্যতীত অধিকাংশ বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানগন আলী রা. কে খেলাফতের দায়িত্বগ্রহণের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত কঠোরতার সাথে তা নাকচ করেন‌। কিন্তু তাদের চাপাচাপি যখন আরো বেড়ে গেল তখন তিনি অপারগ হয়ে তৃতীয় দিন ৩৫ হিজরীর একুশে জিলহজ রোজ সোমবার তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খেলাফতের বাইয়াত গ্রহণের পর তিনি সমস্ত মুসলমানদেরকে একত্র করে এক মাধুর্যপূর্ণ ও তাৎপর্যময় বক্তব্য পেশ করেন তাতে তিনি ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক মিল-মোহব্বত ও সম্প্রীতি বজায় রাখার বিশেষ তাগিদ দেন।

শাহাদত:
হযরত আলী রাঃ এর খেলাফতের পঞ্চম বছর ৪০ হিজরীর ১৭ই রমজান শেষ রাত্রে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে ফজরের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে যাইতেছিলেন। পথিমধ্যে আব্দুর রহমান বিন মুলজিম নামে এক দুর্ভাগা ও জালেম আলী রাঃ এর উপর তরবারির এমন এক আঘাত করে যে তার কপাল থেকে কানের লতি পর্যন্ত কেটে যায়। পাড়ার সমস্ত লোকজন দৌড়ে আসে এবং হত্যাকারীকে গ্রেফতার করে। দুইদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকেন। পরিশেষে ৪০ হিজরীর একুশে রমজান রোজ শনিবার তিনি ইন্তেকাল করেন।ঐ সময় তার বয়স অন্যান্য খলিফা ও রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বয়সের মত ৬৩ বছর হয়েছিল।

কাফন-দাফন:
হযরত আলী রাঃ এর বড় ছেলে হযরত হাসান রাঃ তার জানাযা পড়ান।আর এটাই প্রসিদ্ধ আছে
যে তাকে “বখশে আশরাফ” নামক জায়গায় দাফন করা হয়।

Leave a Reply