পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ বিস্তার

আসিফ আহমাদ

বর্তমান আমাদের সমাজের জন্য অন্যতম একটি সমস্যা হল পর্ন-আসক্তি।। ইন্টারনেট সহজলভ্যতা, দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের অভাব , শিক্ষা সিলেবাসে নৈতিক ও ইসলাম শিক্ষার স্বল্পতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা, ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে উদাসীনতা,পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমদানির সয়লাবসহ অনেকগুলো ফ্যাক্টর ও কারণ এর পিছনে দায়ী। পর্নোগ্রাফির কারণে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে যৌন সহিংসতা বিবাহ বিচ্ছেদ মাদকাসক্তি এমনকি হত্যা ও আত্মহত্যা পর্যন্ত।
অথচ এই সমস্যাটি কে নিয়ে সমাজের সচেতন মানুষজনও কথা বলেন না। যার কারণে এই ব্যাধির বিরুদ্ধে সামাজিক ভাবে যে সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার ছিল এক পারসেন্টও তৈরি হচ্ছে না! অথচ, সামাজিক কোন ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রথমে দরকার ছিল সেই ব্যাধিটিকে ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিতকরণ। এরপর তার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা।

আমরা জানি, বিষয়টি অত্যন্ত সেনসিটিভ। শালীনতাবোধ রক্ষা করে এর আলোচনা অনেক কঠিন। কিন্তু সমাজ যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত তখন আক্রান্ত স্থান কেটে ফেলার জন্য আমাদেরকেতো চাকু-কাঁচি ধার দিতেই হবে।
পর্নোগ্রাফি কতভাবে?
উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন-অর্ধনগ্ন নৃত্য, চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, অঙ্কিত চিত্রাবলী বা অন্য কোন উপায় ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য বিষয় যার কোন শৈল্পিক মূল্য নেই তা পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে। অধিকন্তু যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, পত্রপত্রিকা, ভাস্কর্য, মূর্তি, কল্পমূর্তি, কার্টুন, বা প্রচারপত্র পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে। এসবের সফট ভার্সনও পর্নোগ্রাফি হিসেবে গণ্য হবে।
চিন্তা করুন, কত ভাবে আমাদের মাঝে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। আর এটা শুধু সম্ভাবনা নয়, বরং ইতিমধ্যে এই সবগুলো উপায়ে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়াও হচ্ছে।

ভয়াবহ বিস্তার
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির বিস্তারের ব্যাপারে বিস্তারিত তেমন কোন গবেষণা। বা জরিপ হয়নি। কিন্তু সংক্ষিপ্ত যেসব জরিপ হয়েছে তাতেই মারাত্মক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। 17 সালের জানুয়ারিতে ডয়চেভেলেতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়,- স্কুল ছাত্রদের নিয়ে একটি জরিপ করেছে ‘মানুষের জন্য ফফাউন্ডেশ। দেখা গেছে, ঢাকার স্কুলপড়ুয়াদের প্রায় 77 ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ডয়চে ভেলেকে জানান, “আমাদের এই জরিপটি স্কুলের অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে করা হয়”। আর তাতে দেখা যায়, পর্নোগ্রাফি তারা ছবি অডিও ভিডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে।
এসব পর্নোগ্রাফির অধিকাংশই আবার দেশে তৈরি। এই শিক্ষার্থীরা প্রধানত মোবাইলে অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখে। এর বাইরে ট্যাব ল্যাপটপেও তারা দেখে। পেনড্রাইভের মাধ্যমে আদান-প্রদানও করে।
তিনি আরো বলেন, জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, ৩০-৩৫ বছর যাদের বয়স এবং তাদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের শতভাগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। শুধু তাই নয়, নিয়মিত পর্ণোগ্রাফি দেখেন 90 ভাগ। আর যুব নারীদের মধ্যে সংখ্যাটা 50 ভাগ।
মুক্ত বাতাসের খোঁজে বইয়ে একটি জরিপ উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, “2012 সালে কয়েকটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের উপর যমুনা টিভির জরিপ অনুযায়ী শতকরা 76 জন শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। বাকিরা বাবা মার ফোন ব্যবহার করে। 82% সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ন দেখে, ক্লাসে বসে পর্ণ দেখে 62 শতাংশ। বেসরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে ফটোকপিয়ার মোবাইলে গান রিংটোন ডাউনলোড করার দোকানগুলো থেকে দেশে দৈনিক ২.৫ কোটি টাকার পর্ন বিক্রি হয়। এগুলো আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে তথ্য যখন এনড্রয়েড ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিলনা। বর্তমান অবস্থা কি হতে পারে, কল্পনা করুন।“
উক্ত বইয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে বলা হয়েছে, “আজ আমি, আপনি, আমাদের সন্তান, আমাদের বন্ধু, কেউই নিরাপদ না। সবাই সম্ভাব্য ভিকটিম। পর্ণগ্রাফি আসক্তির ফাঁদে আটকা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর। ভেঙে গেছে পারস্পরিক বিশ্বাস অগণিত পরিবার। কষ্ট হয়েছে অনেক পবিত্র আত্মা এবং সংখ্যাটা ক্রমে বাড়ছে। অন্ধকার গহ্বরের একেবারে কিনারায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যদি এখনও পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতার মাত্রা সম্পর্কে আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আসে, তাহলে অনতিক্রম্য অন্ধকার সমাজকে গ্রাস করে নেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সত্য যতই অপ্রিয় কিংবা অস্বস্তিকর হোক, প্রকাশ করতেই হবে। কারণ, নিরবতার জন্য যে মূল্য দিতে হবে তা অনেক অনেক চড়া। আর আল্লাহ তায়ালা সত্য প্রকাশে কখনো সংকোচ বোধ করেন না। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদেরও করা উচিত না।“(মুক্ত বাতাসের খোঁজে, পৃষ্ঠা: ১২)
তাই বলি, ভয়াবহ এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে এই বিষয়ে সামাজিক ভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পশ্চিমা নগ্ন সংস্কৃতির পরিবর্তে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমরা সবার জন্য তৈরি করতে পারব একটি নির্মল জীবনের পরিবেশ।

Leave a Reply